প্রেম কি দেহনির্ভর নাকি দেহ নিরপেক্ষ ?
◆ একটা কাহিনী বলি :
শকুন্তলা ও দুষ্যন্তের কাহিনী :
- কাহিনীর প্রথম দিক 💌 :
রাজা দুষ্যন্ত গেলেন মৃগয়া করতে, সেখানেই দেখলেন অপূর্ব সুন্দরী শকুন্তলাকে।
কালিদাস, ' অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ ' নাটকে দেখা যায়, রাজা প্রথম দর্শনে শকুন্তলার বর্ণনা করছেন এইভাবে :
" কথামিয়ং সা কণ্বদুহিতা ? অসাধুদর্শী খলু তত্র ভবান্ কাশ্যপঃ য ইমামাশ্রমধর্মে নিযুঙ্ ক্তে।
ইদং কিলাব্যাজমনোহরং বপুঃ তপঃক্ষমং সাধয়িতুং য ইচ্ছতি।
ধ্রুবং স নীলোৎপলপত্রধারয়া শমীলতাং ছেত্তুমৃষির্ব্যবস্যতি ।। ১৭ ।।
ভবতু, পাদপান্তরিত এব এনাং বিস্রব্ধাং পশ্যামি। ( তথা করোতি )
- ড. তুলসীদাস মুখোপাধ্যায় এর অর্থ বলেছেন :
এই কি সেই মহর্ষি কণ্বের কন্যা? পূজনীয় কাশ্যপ নিশ্চয়ই একজন অবিবেচক, কেননা তিনি শকুন্তলাকে আশ্রমের কঠিন কর্মে নিযুক্ত করেছেন।
যে ঋষি স্বভাব-সুন্দর এ দেহকে তপস্যার যোগ্য করার বাসনা পোষণ করেন, তিনি নিশ্চিতরূপে নীল পদ্মের পাপড়ির প্রান্তভাগ দিয়ে শমীশাখা ছেদন করতে চাইছেন।
যা হোক্, বৃক্ষের অন্তরালে অবস্থান করেই একে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখি। তাই করতে লাগলেন।
এরপর, শুরু হল দেহ নির্ভর প্রেম। রাজা মশাই শকুন্তলার দৈহিক সৌন্দর্য্য আর কিছুই ভুলতে পারছেন না। তিনি মনে করছেন, আশ্রম বালা শকুন্তলার সৌন্দর্য্যের জন্য কোনো অলংকারের প্রয়োজন নেই। এই সৌন্দর্য্য পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্যকে হার মানায় !
ঐদিকে শকুন্তলাও শৌর্যে, বীর্যে খ্যাত, সুঠাম দেহধারী রাজাকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। শরীর মন আনচান। দেহের উত্তাপ বেড়ে চলছে। শেষ পযর্ন্ত উভয়ে ' গান্ধর্বমতে' ( বড়দের না জানিয়ে ) বিয়ে করলেন।
☆ এই অংশে, প্রেমকে ' দেহনির্ভর ' দেখানো হয়েছে।
- কাহিনীর পরের অংশ 💌 :
এরপর, রাজ্যের কাজে রাজা নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন ' রাজার একটি আংটি'। শকুন্তলার ঐটাই সম্বল।
কিছুদিন পর, শকুন্তলা নিজের আশ্রমে বসে আছেন। সেইসময় মহা তপস্বী দুর্বাসা মুণি এসে হাজির। শকুন্তলা রাজার ভাবনায় এমন মগ্ন যে, ঋষি এসে ডাকছেন, সেটা শুনতে পান নি। এমনিতেই দুর্বাসা মুণি অভিশাপ দেওয়াতে ওস্তাদ ! তারপর এই রকম অপমান দেখে দিলেন, অভিশাপ দিয়ে, -' শকুন্তলা যার জন্য তাঁক সম্মান করে নি, সেই ব্যক্তিই একদিন শকুন্তলাকে ভুলে যাবে ! ' বেচারা শকুন্তলা ঐটাও শুনতে পেল না!
এরপর, শকুন্তলার দুই সখী দূর থেকে অভিশাপ শুনতে পেয়ে ছুটে এলেন। ঋষির কাছে প্রর্থনা করলেন, এর একটা উপায় দিয়ে যাওয়ার জন্য ! তাদের সখী খুব সরল - এইসব বলল। মুণি নরম হয়ে বললেন, ' রাজার দেওয়া কিছু দেখালে, উপায় হবে। ' এই শুনে সখীরা আশ্বস্ত হল। কারণ, তাদের সখীর হাতে ' আংটি ছিল '। তবে সখীরা ঠিক করল, শকুন্তলাকে কিছু বলবে না। এতে সে কষ্ট পাবে।
এরপর, বাড়ির বড়রা জানতে পারল শকুন্তলা 'মা' হতে চলেছে। সবাই অবাক ! কে পিতা? জিজ্ঞাসা করতে উত্তর পেল - ' রাজা দুষ্যন্ত !' এই শুনে অনেকে খুব অপমান করল শকুন্তলাকে। কেউ কেউ খুশি হল। পালক পিতা কন্ব মুণি ভাবলেন, বিবাহিত কণ্যা স্বামীর কাছেই ভালো থাকবে। তাই শকুন্তলাকে রাজার কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আশ্রমে সাজ সাজ রব। শকুন্তলা চলল শ্বশুরবাড়ির ! নৌকা করে পথে যেতে যেতে শকুন্তলার হাতের আংটিটি গেল পড়ে !
এরপর, শকুন্তলা মহা আনন্দে রাজাকে বললেন, আমি এসেছি, আমাকে স্বীকার কর ! এদিকে রাজা তো সব ভুলে গেছেন ! উলটে শকুন্তলা সহ শকুন্তলার সঙ্গের আশ্রমের মানুষজনদের অপমান করলেন ! প্রচন্ড তর্কাতর্কি হল। শেষপযর্ন্ত শকুন্তলা এত অপমান সহ্য করতে না পেরে বাইরে বের হয়ে এল। সেইসময় তাঁর আসল মা, তাকে নিয়ে ঋষি মরীচের আশ্রমে গেলেন।
এরপর, ঐখানেই শকুন্তলা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, নাম ভরত। আশ্রমে শকুন্তলা কঠোর তপস্যায় মগ্ন হয়। পূজা - অর্চনা করে সময় কাটায়, সাথে পুত্রকে মানুষ করে।
ঐদিকে, এক জেলে মাছ ধরার সময় শকুন্তলাকে দেওয়া রাজার আংটিটা পায়। রাজা জানতে পারেন, এক জেলে তার একটা আংটি মাছ ধরার সময় পেয়েছে। আংটিটা দেখার পরেই রাজার সব মনে পড়ে গেল। রাজামশাইয়ের খুব মন খারাপ হল। রাজ্য শাসন করতে পারেন না, অন্য রাণীদের কাছেও যান না, সবসময় শকুন্তলা আর শকুন্তলা ! রাজার পাগলের দশা হয়েছে !
- কাহিনীর শেষ অংশ 💌 :
এইভাবেই অনেকগুলো বছর কেটে গেল। দেব - অসুর যুদ্ধ শুরু হলে, বচনে আবদ্ধ মর্তের বীর রাজা দুষ্যন্তকে দেবতাদের সহায়তার জন্য যেতে হল। যুদ্ধ করে ফিরে আসার সময় মরীচ মুণির আশ্রমে স্বর্গের সারথি মাতলি থামলেন, রাজাকে নিয়ে গেলেন আশ্রমে।
এরপর, ঐখানে পুনরায় শকুন্তলার দেখা পেলেন, সাথে পুত্রকেও পেলেন।
শকুন্তলার তো সেই রূপ আর নেই ! নেই দেহের লালিত্য ! চুল একবেণী করে বেঁধে রেখেছেন ! শরীর শুকিয়ে গেছে ! মুখে বিরহের ছাপ স্পষ্ট ! - এইরকম শীর্ণকায়, লাবণ্যহীন শকুন্তলাকেও রাজা দুষ্যন্ত আদরে গ্রহণ করেছেন। নিজের খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এরপর, সমস্ত ঋষিদের কাছে আর্শীবাদ নিয়ে, নিজ ধর্মপত্নী ও পুত্রকে সহ নিজ রাজ্যে ফিরে এলেন।
☆ এই অংশে, প্রেমকে 'দেহাতীত' দেখানো হয়েছে।
আমাদের সংস্কৃত স্যার 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম্' এর সম্পর্কে একটি লাইন লিখিয়েছিলেন -
" দেহগত প্রেম, দেহাতীত স্বর্গীয় প্রেমে রূপান্তরিত হল। "
সত্যিই তাই !
- প্রেম কেমন, 'দেহগত' না 'দেহ নিরপেক্ষ' :
◆ সাধারণত, বেশিরভাগই দেহ নির্ভর হয়, পরে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি দেহ নিরপেক্ষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। যেমনটা ' দুষ্যন্ত - শকুন্তলা ' ক্ষেত্রে দেখা গেছে !
◆ বৃদ্ধ হলে তো তাই হবে ! অবশ্য তখনও কেউ যদি দেহগত প্রেম খোঁজেন তাঁর ব্যাপার আলাদা !
◆ আবার দেখা যায়, সঙ্গীর শরীর অসুস্থ হলে অনেকেই নিজেকে সংযত করে, সঙ্গীর ঠিক হওয়া পযর্ন্ত অপেক্ষা করেন। অনেকের সঙ্গী বাইরে থাকে রোজগারের জন্য। তিনমাস বা সাতমাস ছাড়া বাড়িতে এলেও, অন্য সঙ্গী খোঁজে না। তবে মন ঐ দূরের সঙ্গীর কাছেই পড়ে থাকে, দেহ না থাকলেও মনে তার সঙ্গীর ছবি ভেসে থাকে। তখন প্রেম হয় ' দেহ নিরপেক্ষ '। আর যে তা পারে না, তখন প্রেম হয় ' দেহগত'।
◆ একজন সঙ্গী মারা গেলেও অনেকে আর নতুন সঙ্গী খোঁজে না। তাদের পুরানো কথা মনে করে আনন্দে থাকে। তখন প্রেম হয়, ' দেহ নিরপেক্ষ ', আবার অনেকে থাকত পারেন না, তখন প্রেম হয় ' দেহগত '।
এইবার কেউ যদি বলে, এটাই ঠিক, ওটা ভুল - তা হলেই বিপদ ! প্রতিটি ব্যক্তির চাহিদা মনের ভাব আলাদা ! ' প্রেম'কে যে যেমনভাবে ব্যবহার করবে, প্রেম তার কাছে তেমন !
ধন্যবাদ। 🙂
ফুটনোটগুলি