ল্যাসিক সার্জারি কী? এটিতে ঠিক কী করা হয়? এই সার্জারি কারা করাতে পারেন? ল্যাসিক সার্জারির বিষয়ে বিশদে জানাতে পারেন কি?
চশমা পরে নয়, সার্জারি করে খারাপ চোখে স্বাভাবিক দেখুন
ল্যাসিক (এল এ এস আই কে) কথাটি কয়েকটি শব্দের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি। তার মানে পুরো কথাটি হল লেজার অ্যাসিস্টেড ইন-সিটু কেরাটোমিলিউসিস। চোখের রিফ্রেক্টিভ এরর ঠিক করার সার্জারিকেই ল্যাসিক সার্জারি বলা হয়। এটি একেবারে ঝঞ্ঝাট ও ব্যথাহীন সার্জারি। সার্জারি করার সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু ভাল দেখা যায় এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়।
রিফ্রেক্টিভ এরর
আমাদের চোখে আলোকরশ্মি ঢুকে কর্নিয়া ও লেন্সের সাহায্যে ফোকাস হয়ে রেটিনার ওপরে একটি স্বচ্ছ ছবি তৈরি করে। যদি ফোকাসের কাজ ঠিকমতো না হয়, তাহলে রেটিনার ওপরে আবছা ছবি তৈরি হবে। আসলে চোখের ফোকাস করার ক্ষমতা কম থাকলে এই ধরনের সমস্যা হয়। একেই রিফ্রেক্টিভ এরর বলে।
রিফ্রেক্টিভ এররের প্রকার
রিফ্রেক্টিভ এরর নানা প্রকারের হতে পারে। যেমন, মায়োপিয়া। এই সমস্যায় কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধে না হলেও দূরের জিনিসকে অস্পষ্ট লাগে। মায়োপিয়াতে আইবলের লেন্স স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বড় হয়। এর ফলে আলোকরশ্মি রেটিনার সামনে কেন্দ্রীভূত হয়। এতে মাইনাস পাওয়ারের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে হাইপারমেট্রোপিয়াতে দরকার হয় প্লাস পাওয়ারের। এই ক্ষেত্রে আলোকরশ্মি রেটিনার পেছনে কেন্দ্রীভূত হয়। অ্যাস্টিগমেটিজমে একটি নির্দিষ্ট অ্যাক্সিসে পাওয়ার থাকে, যাকে সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার বলে। এই সমস্যায় দূরের এবং কাছের দেখা দুটি ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়। আইবলের গঠনগত পরিবর্তনের জন্য ছবি স্পষ্টভাবে রেটিনায় তৈরি হয় না।
রিফ্রেক্টিভ এরর সংশোধনে ল্যাসিক সার্জারি কতটা কার্যকর
রিফ্রেক্টিভ এরর সংশোধনের জন্য যে সার্জিক্যাল পদ্ধতিগুলো রয়েছে তার মধ্যে জনপ্রিয়তম হল ল্যাসিক সার্জারি। এই সার্জারিতে খুব সুক্ষ্মভাবে কর্নিয়ার মাঝের টিস্যু অর্থাৎ স্ট্রোমার একটি অংশ এক্সিমার লেজারের সাহায্যে অপসারণ করা হয়। মাইক্রোকোরাটোম বা লেজার দিয়ে কর্নিয়ার ওপরের অংশে একটি ফ্ল্যাপ তৈরি করা হয়। ফ্ল্যাপের একটি দিক হিঞ্জের মতো করে রাখা থাকে। কারণ কর্নিয়াতে যে ফ্ল্যাপটা তৈরি হল সেটাকে উল্টে কর্নিয়ার মূলকেন্দ্র থেকে সরিয়ে রাখা হয়। কর্নিয়ার মাঝের স্ট্রোমা লেয়ারের কিছু টিস্যু লেজার দিয়ে সুক্ষ্মভাবে সরিয়ে দেওয়া হয় বা কর্নিয়ার আকৃতিগত পরিবর্তন করা হয়। কর্নিয়ার এই আকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে কর্নিয়ার ফোকাসিং পাওয়ারে পরিবর্তন আসে। যতটা রিফ্রেক্টিভ এরর রয়েছে সেই অনুসারে স্ট্রোমা লেয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার পর আগে থেকে তৈরি রাখা ফ্ল্যাপটা যথাস্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে কর্নিয়ার ওপরের আকৃতি একই থাকে এবং কর্নিয়ার ফোকাস করার ক্ষমতা ঠিক হয়ে যায়। ফলে চশমা বা কনট্যাক্ট লেন্সের দরকার পড়ে না। কর্নিয়া নিজেই আলোকে ঠিকমতো রেটিনায় ফোকাস করতে পারে।
কারা ল্যাসিক সার্জারি করাতে পারেন
- আঠারো বছর বয়সের আগে এই সার্জারি করা যাবে না
- এক বছর রিফ্র্যাকশন বা চশমার পাওয়ার একই থাকা দরকার। যদি পাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে জেনেও সার্জারি করা হয়, তা হলে আবার রিফ্র্যাকটিভ এরর দেখা দেবে। তখন আবার চশমা পরতে হবে বা সার্জারি করতে হবে
- চোখের স্বাস্থ্য ভাল হওয়া প্রয়োজন। চোখের কোনও অসুখ, যেমন, কর্নিয়ার কোনও অস্বাভাবিকতা, সংক্রমণ ইত্যাদি থাকা চলবে না
কারা করাতে পারেন না
- যাঁদের রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস বা এস এল ই আছে, তাঁদের ল্যাসিক সার্জারি না করাই ভাল
- যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা বা ব্রেস্ট ফিডিং করান তাঁদের রিফ্র্যাকটিভ এরর কারেকশন সার্জারি করা হয় না
- অন্য কোনও রোগ থেকে যাঁদের চোখের দৃষ্টিশক্তি কমা-বাড়া করে তাঁদের এই সার্জারি না করাই ভাল
- কানেক্টিভ টিস্যু ডিসঅর্ডার থাকলে এই সার্জারি এড়িয়ে যাওয়া উচিত
- যাঁরা বক্সিং, রেসলিং, মার্শাল আর্টের মতো খেলার সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ, যেখানে চোখে আঘাত লাগার ঝুঁকি বেশি, তাঁদের এই সার্জারি করা হয় না
- চোখে কেরাটোকোনাস বা কোনও সংক্রমণ বা গ্লুকোমা থাকলে ল্যাসিক সার্জারি করা হয় না
- চোখে কোনও আঘাত বা সার্জারির ইতিহাস থাকলে এই সার্জারি এড়িয়ে চলাই ভাল
- চোখে বা চোখের পাতায় কোনও ইনফ্ল্যামেশন থাকলে এই সার্জারি একেবারেই নয়
- কর্নিয়া পাতলা থাকলে ল্যাসিক সার্জারি করা হয় না
- ড্রাই আইয়ের সমস্যা থাকলে এই সার্জারি এড়িয়ে যাওয়াটাই মঙ্গল
চোখের পাওয়ার ও ল্যাসিক সার্জারি
চোখের কত পাওয়ার পর্যন্ত এই সার্জারি করা যাবে তা নির্ভর করছে কর্নিয়ার অবস্থার ওপর। এখন কতটা পাওয়ারের জন্য কর্নিয়ার কতটা অংশ সার্জারি করে বের করা হবে তার একটা হিসেব রয়েছে। ল্যাসিক সার্জারি করাতে এলে আগে রোগীর কর্নিয়ার স্থুলত্ব মেপে নেওয়া হয়। সেটা যদি নির্ধারিত মানের চেয়ে কম হয় তাহলে সার্জারি করা যায় না। মাইনাস পাওয়ার খুব বেশি থাকলে এই সার্জারি না করাই ভাল।
কতটা কষ্টকর
একেবারেই কষ্টকর নয়। এটি একটি আউটডোর সার্জারি, মানে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। লোকাল অ্যানাস্থিশিয়া করে চোখকে প্রথমে অসাড় করে নেওয়া হয়। একটা চোখে পুরো পদ্ধতি সম্পূর্ণ করতে মাত্র ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে।
কৃতজ্ঞতা- ১) ডাঃ সিদ্ধার্থ ঘোষ ২) ছবির জন্য গুগল