যন্ত্রণা বা রক্তপাত যাই হোক না কেন, ‘পাইলস বা অর্শ হয়েছে’ গোছের একটা আদ্দিকালের ধারণা নিয়ে তাঁরা বসে থাকেন। এই নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান না, যেন মলদ্বারের সব রোগই এক। যেন মলদ্বারের রোগ নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত। যেন মাওবাদী তকমা জুটে যাবে তাতে। এক অদ্ভুত নির্লিপ্তি অথবা উন্নাসিকতা তাঁদের ঘিরে থাকে। অথচ বিশ্বের নানা প্রান্তের লক্ষ লক্ষ লোক নিজেদের কোনও দোষ ছাড়াই এই রোগের শিকার। এবারে মূল প্রসঙ্গে আসি। ফিসচুলা আসলে শরীরে তৈরি হওয়া এক ধরনের অস্বাভাবিক সুড়ঙ্গ। চলতি কথায় একে ‘নালি ঘা’ বলে। ভগন্দর নামেও এর পরিচিত আছে।
রোগটি ঠিক কী: ফিসচুলা শরীরের এক গহ্বরের সঙ্গে অন্য গহ্বরের কিংবা এক গহ্বরের সঙ্গে শরীরের পৃষ্ঠতল অর্থাৎ ত্বকের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করে। শরীরের এক গহ্বরের সঙ্গে অন্য গহ্বরের সংযোগের উদাহরণ– মলনালি বা রেক্টাম এবং যোনি বা ভ্যাজাইনার মধ্যে যোগাযোগ। অন্যদিকে রেক্টাম ও শরীরের বহির্ভাগ বা পৃষ্ঠতলের মধ্যেও সংযোগ স্থাপিত হতে পারে।
প্রকার: ফিসচুলা মূলত দুই ধরনের হয়। অ্যানাল ফিসচুলা ও রেক্টোভ্যাজাইনাল ফিসচুলা।
অ্যানাল ফিসচুলা
যে ফিসচুলা পায়ু নালিপথ বা অ্যানাল ক্যানালের সঙ্গে মলদ্বার বা অ্যানাসের কাছাকাছি ত্বকের সংযোগ ঘটায় সেটাই অ্যানাল ফিসচুলা। পৃথিবীর কোনও স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতিতেই এই রোগের ওষুধ নেই। অস্ত্রোপচারই এই রোগের প্রথম ও শেষ চিকিৎসা।
কেন হয়: প্রকৃতপক্ষে অ্যানাল ক্যানালে তৈরি হওয়া এক বা একাধিক ফোঁড়া, যা আসলে পুঁজভর্তি থলে, অ্যানাল ফিসচুলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। অ্যানাল ক্যানালের ভেতরে থাকা টিস্যুগুলির মধ্যে থাকা সংক্রমণযুক্ত এই সব ফোঁড়া ফেটে গেলে বা উন্মুক্ত হয়ে পড়লে ফোঁড়ার ভেতরে থাকা পুঁজ ও তরল বাইরে বরিযে আসে এবং সংক্রমণকে তীব্রতর করে ধীরে ধীরে শরীরের মধ্যে সুড়ঙ্গপথের সৃষ্টি করে। এর পরে ফোঁড়া শুকিয়ে যায় ঠিকই, তবে সুড়ঙ্গ কিন্তু থেকেই যায়।
- ইতিহাসে ফিসচুলা
আপনি কি জানেন যে লিখিত তথ্য থেকে যতটুকু জানা গেছে তাতে আধুনিক যুগে ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে জন অফ আরড্রেন সর্বপ্রথম যে অস্ত্রোপচারটি করেছিলেন সেটি ছিল ফিসচুলা সংক্রান্ত? এটি এমন একটি তথ্য যা মলদ্বারের রোগকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
ঝুঁকি: ডাইভার্টিকোলাইটিস, কোলাইটিস অথবা ক্রোনস ডিজিজে আক্রান্তদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেখা গেছে, ক্রোনস ডিজিজে আক্রান্তদের ২৫% রোগীর ক্ষেত্রে ফিসচুলা হয়। এ ছাড়াও যে সব রোগে শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় সেই সব রোগ থেকে অ্যানাল ফিসচুলা হতে পারে।
উপসর্গ: অ্যানাল ফিসচুলার উপসর্গ হল অ্যানাল ফোড়া এবং ফিসচুলায় চলতে থাকা ব্যথা ও স্ফীতি। এ ছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি ফোড়া থেকে বেরিয়ে আসা দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ, রক্ত ও তরলের উপস্থিতি অনুভব করেন। বারে বারে জামাকাপড় পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। এইসব নিঃসৃত পদার্থের বিক্রিয়ায় মলদ্বার বা অ্যানাসের কাছাকাছি অঞ্চলের ত্বকে জ্বালা ও চুলকানি হতে পারে। ফুলে গিয়ে ব্যথাও হতে পারে। অন্যান্য উপসর্গ হল জ্বর, শীত-শীত ভাব, অবসন্নতা ও দুর্বলতা।
রেক্টোভ্যাজাইনাল ফিসচুলা
এই ফিসচুলায় রেক্টাম ও ভ্যাজাইনার মধ্যে অস্বাভাবিক সুড়ঙ্গ পথের দ্বারা সংযোগ স্থাপিত হয়।
কেন হয়: অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের সময় ভ্যাজাইনা ও অ্যানাসের অন্তর্বর্তী অঞ্চলের পেরিটোনিয়াম টিস্যুতে আঘাত লাগার কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, “Obstetric fistula is the most dramatic aftermath of neglected childbirth”. তাদের হিসেব অনুসারে রেক্টোভ্যাজাইনাল ফিসচুলায় আক্রান্ত আনুমানিক ২০ লক্ষ মহিলা চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না এবং আনুমানিক ১ লক্ষ মহিলা প্রতিবছর এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়াও রেডিয়েশন চিকিৎসা, ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, ভ্যাজাইনা কিংবা অ্যানাসের অস্ত্রোপচার কিংবা অ্যানাসের ক্ষতের কারণেও এই রোগ হতে পারে। রেক্টোভ্যাজাইনাল ফিসচুলা গোটা বিশ্বের সমস্যা হলেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে ইদানিং এই রোগ আর দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ, এই সব দেশ নাগরিক অধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। সেখানে খুব যত্ন ও গুরুত্ব সহকারে প্রসবকালীন যত্ন নেওয়া হয়। তাই নাগরিকেরা উপকৃত হচ্ছেন।
বর্তমানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সেই সব দেশেও অত্যন্ত কম যেখানে বাল্যবিবাহে বাধা ও স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে যথেস্ট উৎসাহ দেওয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, বিশেষ করে আফ্রিকার কিছু অংশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার (ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও নেপাল) ব্যাপক অংশে এই রোগের সমস্যা আজও চিন্তার কারণ।
উপসর্গ: ব্যথা ও যন্ত্রণা ছাড়াও মাঝে মাঝে যোনিপথ বা ভ্যাজাইনা দিয়ে মল বা দুষিত বায়ু বেরিয়ে আসা এই রোগের সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ। কখনও কখনও এই পথে কৃমিও বেরিয়ে আসে। সব কিছু মিলে আক্রান্ত মহিলাটিকে তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যে থাকতে হয়। এ ছাড়াও আক্রান্ত মহিলা যোনি প্রদাহের সমস্যায় ভুগতে পারেন। সেক্ষেত্রে যোনিপথে জ্বলুনি, চুলকানি ও ক্ষরণ হতে পারে। অন্য দিকে মূত্রথলির প্রদাহ হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় ও কখনও কখনও প্রস্রাব করার সময় যন্ত্রণা হয়।