Otto von Bismarck — 'One day the great European War will come out of some damned foolish thing in the Balkans (1888).'
১৮-১৯ বছরের একটা ছেলে ১ম বিশ্বযুদ্ধ যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে। ব্যাকগ্রাউন্ডের জটিল আলোচনা বাদ দিয়ে, সোজাভাবে ব্যাপারটা বলি। গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ বসনিয়ার একটা ছেলে। ছেলেটা একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠনের মেম্বার, সংগঠনের নাম ইয়াং বসনিয়া। সদস্যরা মূলত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
"ইয়াং বসনিয়া" নাম শুনলে মনে হবে, পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে ক্লাব বানিয়ে ক্রিকেট-ফ্রিকেট খেলে এমন কিছু একটা। কিন্তু না, "ইয়াং বসনিয়া"র বড় উদ্দেশ্য ছিল। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে সার্বিয়ার সাথে একীকরণের মাধ্যমে যুগোস্লাভিয়ার সৃষ্টি ছিল এদের উদ্দেশ্য। ১৯০৮ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সম্রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়। সারাজেভো বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। ইয়াং বসনিয়া ছেলেরা বিশ্বাস করত যে এই অঞ্চলগুলি সার্বিয়ার অংশ।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী ১৯১৪ সালের জুনে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় সশস্ত্র বাহিনী পরিদর্শন করার জন্য যান। গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ গুলি করে তাদের মেরে ফেলে।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সার্বিয়ার কাছে দাবি করে তাদের সার্বিয়ার ভেতরে ঢুকে তদন্ত, ধরপাকড় ও বিচার করার সুযোগ দিতে হবে। দাবি মেনে নিতে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেয়। এই আল্টিমেটাম কিন্তু বিএনপির ''ঈদের পরে আন্দোলন" এর মত কথার কথা ছিল না।
সার্বিয়া তার ভূখণ্ডে তদন্ত-ধরপাকড়-বিচার করার সুযোগ দিতে রাজি হলো না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করল।
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বন্ধু জার্মানি। তাদের মধ্যে আগের একটা চুক্তিও ছিল। জার্মানি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে সাপোর্ট করল। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি একটি জার্মানভাষী রাষ্ট্র ছিল।
জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম আশা করেছিলেন যে যুদ্ধ বাধলে জনসাধারণ তাকে সাপোর্ট করবে। তখন সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উত্থান হচ্ছিল জার্মানিতে। তারা কাইজারকে পছন্দ করত না। জনসমর্থন টানার জন্যে শাসকেরা যুদ্ধে জড়ায়। এটা রাজনীতির একটা ক্লাসিক্যাল ট্রিক। এখনকার আমেরিকা এই ট্রিকের চর্চা করে।
রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষে যোগ দেয়।
কেন রাশিয়া সার্বিয়াকে সাহায্য করল তার অনেকরকম ব্যাখ্যা আছে। দুই দেশের বেশিরভাগ মানুষ একই জাতিগোষ্ঠীর — স্লাভিক। তাছাড়া রাশিয়া টার্কিক স্ট্রিটের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল (কৃষ্ণ সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার জলপথ)। অস্ট্রিয়া সঙ্গে কিছু পূর্ব মতবিরোধও অন্যতম কারণ।
রাশিয়া ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সাথে আগে থেকেই জোটবদ্ধ ছিল। এই জোটের নাম ট্রিপল আঁতাত (Triple Entente), Entente শব্দটা ফরাসি, মানে বন্ধুত্ব।
অন্যদিকে ট্রিপল অ্যালায়েন্স হ'ল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইতালির মধ্যে একটি সামরিক জোট (একত্র হয়ে লড়াইয়ের চুক্তি) যা ১৯৮৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। অন্য দেশ তাদের আক্রমণ করলে তিনটি দেশ একে অপরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ইতালি একটা ধান্ধা করার চেষ্টা করল। সীমান্তবর্তী দেশের সাথে জায়গা-জমি নিয়ে দ্বন্দ থাকাটা অস্বাভাবিক না। ইতালির সেটা ফ্রান্সের সাথেও ছিল, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাথেও ছিল। ইতালির নেতারা যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে কীভাবে সর্বাধিক সুবিধা অর্জন করবেন তা বিবেচনা করেছিলেন।
১৯১৫ সালে, ইতালি লন্ডনের গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর শর্তাবলী অনুসারে, ইতালি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়ন্ত্রণ পাবে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি ছিল বেশি লোভনীয়। ইতালি ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নামে।
জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য এবং বুলগেরিয়া কেন্দ্রীয় শক্তি বা চতুর্ভুজ জোট নামে সঙ্ঘবদ্ধ হয়।
বেলজিয়াম জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে একদিকে জার্মানি এবং অন্যদিকে ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেনের যুদ্ধে বেলজিয়ামকে কিছুটা "নিরপেক্ষ" থাকতে হয়েছিল। বেলজিয়াম বড় শক্তিগুলির মধ্যে স্যান্ডুইস হয়ে পড়ে।
ইসমাইল এনভার পাশা ছিলেন অটোমান সামরিক কর্মকর্তা এবং ১৯০৮ সালের তুর্কি বিপ্লবের নেতা। তিনি বাল্কান যুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান নেতা ছিলেন। ১৯১৪ সালের ২ আগস্ট অটোমান সাম্রাজ্য এবং জার্মান সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের অধীনে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকা নিরপেক্ষ ছিল এবং মিত্রশক্তির (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং রাশিয়া) পক্ষের যুদ্ধে প্রবেশ করে। অনেক আমেরিকান যুদ্ধে প্রবেশের পক্ষে ছিল না এবং নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল। যুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র শিল্প, অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে বিশ্বনেতায় পরিণত হয়। বিশ্ব একে অপরের সাথে আরও সংযুক্ত হয়ে ওঠে, যা আমরা "বিশ্ব অর্থনীতি" বলি তার সূচনা হয়।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার পক্ষে অন্যান্য মিত্র দেশগুলির মধ্যে রয়েছে পর্তুগাল, জাপান, গ্রীস, রোমানিয়া, চীন এবং যুদ্ধের সমাপ্তির দিকে ব্রাজিল এবং পেরু সহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক সমর্থন রক্ষা করার জন্য পর্তুগাল ব্রিটেন এবং মিত্রদের পক্ষে যুদ্ধে দেয়। পর্তুগালের অংশগ্রহণ প্রথমে নৌ সহায়তায় সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পর্তুগাল ৫০,০০০ লোকের একটি সৈন্যবাহিনী - পশ্চিম ফ্রন্টে প্রেরণ করে।
জাপান মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসাবে ইম্পেরিয়াল জার্মান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দেশটির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য, জাপান বুঝতে পেরেছিল যে তাদের আরও খাদ্য প্রয়োজন। জাপান জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা আশা করেছিল যে জার্মানরা যদি হেরে যায় তবে জাপান চীনের এমন জমি পেতে পারে যা জার্মানির নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১৯১৭ সালের ১৪ ই আগস্ট চীন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। চীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল যুদ্ধোত্তর দর কষাকষির টেবিলে নিজেকে স্থান পাকা করা। চীন প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার জন্যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মৃত্যু ও হতাহতের দিক থেকে বিরাট ক্ষতির কারণ ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ান এবং নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পস (ANZAC) হিসাবে একসাথে দলবদ্ধ হয়েছিল। ANZAC ব্রিটিশ, ফরাসী এবং অন্যান্য মিত্রদের পক্ষে লড়াই করেছিল। বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বাস করছিল যে যুদ্ধে অংশ নেওয়া অস্ট্রেলিয়াকে একটি নতুন জাতি হিসাবে 'প্রমাণ' করবে।
ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব আফ্রিকা এবং পশ্চিম ফ্রন্টে জার্মান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের হয়ে লড়াইয়ের সময় ১৩ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় সৈন্য কাজ করেছিল। ফর্টিনাইনথ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের হয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই রেজিমেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মি অংশ ছিল। এমনকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও এই রেজিমেন্টে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। পারেননি চোখের সমস্যার কারনে।