কোরআনের আলোকে ইসলামে নারীর আত্মিক অধিকার: আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কোরআনে নারীদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাজিল করে নারীর মর্যাদা এবং সম্মান বৃদ্ধি করে দিয়েছে। সেটি হলো ‘সূরা নিসা’। এই সূরায় নারীদের অধিকার বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
পশ্চিমাদের একটি বড় ভুল ধারণা এই যে, তারা মনে করে ইসলামে জান্নাত শুধু পুরুষদের জন্য,নারীদের জন্য নয়।
এছাড়াও হিন্দু ধর্মে নারীকে পাপী হিসেবে গণ্য করা হয়।Professor India গ্রন্থে বলা হয়েছে, There is no creature more sinful than woman. Woman is burning fire. She is the sharpedge of the razor she is verily all there in a body. অর্থাৎ ‘নারীর ন্যায় এত পাপ-পঙ্কিলতাময় প্রাণী জগতে আর নেই। নারী প্রজ্জ্বলিত অগ্নি স্বরূপ। সে ক্ষুরের ধারালো দিক। এই সমস্তই তার দেহে সন্নিবিষ্ট’।
নারীদের প্রতি ঘৃণাভরে বলা হয়েছে, Men should not love their অর্থাৎ ‘নারীদেরকে ভালবাসা পুরুষদের উচিৎ নয়’।
ইহুদী ধর্মে নারীর প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সতী নারীর চেয়ে পাপিষ্ট পুরুষও শতগুণে ভাল’। তারা নারীকে যাবতীয় পাপ ও মন্দের মূল কারণ হিসাবে গণ্য করেছে।
ইসলাম পূর্ব যুগে নারীদের উপর অধিক অত্যাচার করা হত। তাদেরকে কোন সম্মান মর্যাদা দেওয়া হতো না। কন্যা সন্তান হলে জীবন্ত কবরে পুঁতে ফেলা হতো।সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় জীবনযাপন করছিল, আরব ও অন্যান্য দেশে তাদেরকে পশু বলে মনে করা হ’ত এবং মানুষ হিসাবে তাদের কোন মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হ’ত না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
মহান আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন:
وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِنَ الصّٰلِحٰتِ مِنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِکَ یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ وَ لَا یُظۡلَمُوۡنَ نَقِیۡرًا .[১]
আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে নেককাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুর বীচির আবরণ পরিমাণ যুলমও করা হবে না।
এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন: জান্নাতে প্রবেশের জন্য লিঙ্গ কোন মাপকাঠি নয় বরং যারা ভালো কাজ করবে মহান আল্লাহর আদেশ মত জীবন পরিচালনা করবে মহান আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেনঃ
مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡیِیَنَّهٗ حَیٰوۃً طَیِّبَۃً ۚ وَ لَنَجۡزِیَنَّهُمۡ اَجۡرَهُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ [২]
যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই ইবাদতের ক্ষেত্রে। যারা মহান আল্লাহর আদেশ পালন করবে,নিষেধ থেকে বিরত থাকবে মহান আল্লাহ তাদের অবশ্যই উত্তম প্রতিদান দান করবেন ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে নর-নারীর একই প্রকৃতির আত্মা রয়েছে এবং মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَ بَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِهٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا [৩]
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফ্স থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চেয়ে থাক। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। আল-বায়ান
আল্লাহ তা'য়ালা আত্মা মানবের মধ্যে ফুঁকে দিলেন।মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন
فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ .[৪]
‘অতএব যখন আমি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেব এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার জন্য সিজদাবনত হও’।
আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন যেন মানুষ তার ফরমান দুনিয়ায় জারি করতে পারে।মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰهُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰهُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰهُمۡ عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا [৫]
আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিয্ক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি।
এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছেন সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক।
বিকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোতে দেখা যাবে মানবতার পতনের জন্য শুধু হাওয়া (আ)কে দায়ী করা হয়েছে এবং মূল পাপের বিশ্বাস অনুযায়ী হাওয়া (আ) এর কারণে সকল মানবতা পাপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। বাস্তবে যদি আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি দেখবো গর্ভধারণ এবং শিশু জন্মদানের মাধ্যমে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে মহান আল্লাহ তায়ালা। এরশাদ করেন:
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰی وَهۡنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡکُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡکَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ [৬]
আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।
মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন:
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ اِحۡسٰنًا ؕ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ کُرۡهًا وَّ وَضَعَتۡهُ کُرۡهًا ؕ وَ حَمۡلُهٗ وَ فِصٰلُهٗ ثَلٰثُوۡنَ شَهۡرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ اَشُدَّهٗ وَ بَلَغَ اَرۡبَعِیۡنَ سَنَۃً ۙ قَالَ رَبِّ اَوۡزِعۡنِیۡۤ اَنۡ اَشۡکُرَ نِعۡمَتَکَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنۡ اَعۡمَلَ صَالِحًا تَرۡضٰهُ وَ اَصۡلِحۡ لِیۡ فِیۡ ذُرِّیَّتِیۡ ۚؕ اِنِّیۡ تُبۡتُ اِلَیۡکَ وَ اِنِّیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ [৭]
আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, ‘হে আমার রব, আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার উপর ও আমার মাতা-পিতার উপর যে নিআমত দান করেছ, তোমার সে নিআমতের যেন আমি শোকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’।
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা'আলা নারীর-মর্যাদা কে অনেকখানি বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তা'আলা আরো ইরশাদ করেন:
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا [৮]
“নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকিরকারী পুরুষ ও অধিক যিকিরকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”
এ আয়াতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে ইসলামে আত্মিক কর্তব্য, নৈতিক কর্তব্য নারী-পুরুষের জন্য সমান। উভয়কে ঈমান আনতে হবে,সালাত আদায় করতে হবে, সৎ কাজ পালন করতে হবে, যাকাত প্রদান করতে হবে। মহান আল্লাহর সকল আদেশ মান্য করতে হবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে ইসলাম নারীদের জন্য বিশেষ শিথিলতা প্রদর্শন করেছে যদি তিনি ঋতুবর্তী বা গর্ভবতী হন তাহলে তাকে রোজা রাখতে হবে না।তবে পরবর্তীতে স্বাস্থ্য ভালো হলে রোযা পালন করবে। ঋতুকালীন এবং সন্তান জন্মদানের পর তাকে নামাজ পড়তে হয় না, এবং পরবর্তীতে ও আদায় করতে হবে না।
তথ্যসূত্র:
১. সূরা নিসা আয়াত নং ১২৪
২. সূরা নাহল আয়াত নং ৯৭
৩. সূরা নিসা আয়াত নং ০১
৪. সূরা আল হিজর আয়াত নং ২৯
৫. সূরা ইসরা আয়াত নং ৭০
৬. সূরা লোকমান আয়াত নং ১৪
৭.সূরা কাহাফ আয়াত নং ১৫
৮. সূরা আহযাব আয়াত নং ৩৫
লিখেছেন, Mariyam Binte Mohammad Ali