মনমুগ্ধকর সে ঘটনাটিতে যাওয়ার পূর্বে আসুন, তার সম্মন্ধে জেনে নিই সামান্য কিছু-
ডা. মরিস বুকাইলি (MAURICE BUCAILLE) -র জন্ম হয় ১৯ জুলাই, ১৯২০ ইং সালে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ ইং সালে। তার পিতার নাম মরিস এবং মাতা ছিলেন মারি (জেমস) বুকাইলি। ডা. মরিস বুকাইলি ছিলেন খ্যাতনামা একজন ফরাসি চিকিৎসক।তবে তাঁর কর্মজীবন শুধু চিকিৎসা জগতেই সীমাবদ্ধ নয়, নাম কুড়িয়েছেন একজন প্রসিদ্ধ গবেষক হিসেবেও। মরিস বুকাইলি ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কের একজন একনিষ্ঠ গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম, বিশেষত ইসলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোর বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ।
১৯৮১ সালের কথা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্যান্সিসকো মিত্রা ক্ষমতায় এলেন। মিশর সরকারের কাছে চিঠি গেল। তাদের হাজার বছর আগের ‘ফারাও’ (ফিরআউন) নামক শাসকদের মমিগুলো লাগবে। ফ্রান্স পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায়। মিশর সেই প্রস্তাবে রাজি হলো। কাজেই কায়রো থেকে ফিরাউনের যাত্রা হল প্যারিস! প্লেনের সিড়ি থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, তার মন্ত্রীবর্গ ও ফ্রান্সের সিনিয়র অফিসারগণ লাইন দিয়ে দাড়ালেন এবং মাথা নিচু করে ফিরাউনকে স্বাগত জানালেন!!
যখন ফিরাউনকে জাঁকালো প্যারেডের মাধ্যমে রাজকীয়ভাবে বরণ করে, তার মমিকে ফ্রান্সের প্রত্নতাত্তিক কেন্দ্রের একটা বিশেষ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল, যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় সার্জনরা আছে এবং তারা ফিরাউনের মমিকে অটপ্সি (ময়নাতদন্ত) করে সেটা স্টাডি করবে ও এর গোপনীয়তা উদঘাটন করবে।মমির উপর গবেষণা করা শুরু হলো,
এই গবেষণার দলের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন ড. মরিস বুকাইলি নামক একজন গবেষক। তিনি পেশায় একজন ডাক্তার ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট। কিন্তু গবেষণা করার সময় দেখলেন, ফারাওদের একজনের দেহে লবণের রেমনেন্টস আছে। মূলত তার মৃত্যু হয়েছিল সমুদ্রে ডুবে; এর স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণও পেয়ে গেলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, অন্য দেহগুলোর তুলনায় এই দেহটি অধিক সজীব।তার শরীরে লবণ অবশিষ্ট ছিল: এইটা সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে সে (ফিরাউন) ডুবে মারা গিয়েছিল এবং তার শরীর ডোবার পরপরই সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র [লোহিত সাগর] থেকে তুলে আনা হয়েছিল! তারপর লাশটা সংরক্ষণ করার জন্য দ্রুত মমি করা হল।
কিন্তু এখানে একটা ঘটনা প্রফেসর মরিসকে হতবুদ্ধ করে দিল, যে কিভাবে এই মমি অন্য মমিদের তুলনায় একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় থাকল, যদিওবা এটা সমুদ্র থেকে তোলা হয়েছে [কোন বস্তু যদি আদ্র অবস্থায় থাকে ব্যাকটেরিয়া ঐ বস্তুকে দ্রুত ধ্বংস করে দিতে পারে, কারণ আদ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করবেন। কিন্তু বাঁধ হয়ে দাঁড়ালো খ্রিস্টান সহকর্মীরা। তাদের দাবী, তিনি যদি এই রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তাহলে কুরআনের সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে, কেউ একজন তাকে বলল যে কুরআনে বলা আছে যে ফিরাউনের ডুবা ও তার লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে।
এই ঘটনা শুনে ডা. মরিস বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং প্রশ্ন করতে লাগলেন, এটা কিভাবে সম্ভব? এই মমি পাওয়া গিয়েছে মোটে ১৮৮১ সালে, আর কুরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে!! আরবেরা প্রাচীন মিসরীয়দের মমি করার পদ্ধতিতো জানতোই না, মাত্র কয়েক দশক আগে আমরা জানলাম!কিন্তু মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪০০ বছর আগেই এটা সম্পর্কে জানতেন? একের পর এক প্রশ্ন যেন পিছু ছাড়ছে না তার।
নাছোড়বান্দা প্রফেসর বুকাইলি। প্রশ্নগুলোর উত্তর তাকে পেতেই হবে। তিনি এও বুঝে ফেললেন, এসব প্রশ্নের উত্তর হুবহু পেতে হলে তাকে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করতে হবে। সেগুলোতে উপস্থাপিত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে।তিনি তোরাহ্ (তাওরাত) আনালেন এবং সেটা পড়লেন। তোরাহতে বলা আছে, পানি আসলো এবং ফিরাউনের সৈন্য এবং তাদের যানবাহনগুলোকে ঢেকে দিল, যারা সমুদ্রে ঢুকল তাদের কেউই বাঁচতে পারল না। ডা. মরিস বুকাইলি হতবুদ্ধ হয়ে গেলেন যে বাইবেলে লাশের সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুই বলা নেই!!
গবেষনা শেষে, ফ্রান্স একটি চমৎকার কাচের কফিনে মমিকে রেখে মিশরে ফেরত পাঠালো । কিন্তু,মরিস বুকাইলির মন তখনো সন্ধিহান, তাই তিনি তার লাগেজ গুছিয়ে সৌদি আরব ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেখানে মুসলিম শারীরতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি মেডিকেল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।সেখানে তারা তাদের আবিষ্কারের কথা বলেছিল, অর্থাৎ ফেরাউনের লাশ ডুবে যাওয়ার পরেও অক্ষত ছিল এই বিষয়ে, তখন সম্মেলনের একজন লোক, কুরআন খুলে এবং আয়াত পাঠ করে যেখানে মহান আল্লাহ বলেন,
“ আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পার।’ অধিকাংশ মানুষই আমার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিতই উদাসীন।’’{ইউনুস: 92}
তিনি এই আয়াতের দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়ে পড়লেন এবং দর্শকদের (মুসলিম সার্জন) ভীষণভাবে অভিভূত হয়ে পড়লেন এবং তিনি তার জোর গলায় চিৎকার দিয়ে বললেন: আমি ইসলামে প্রবেশ করেছি এবং আমি এই কুরআনে বিশ্বাসী।
নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরে গেলেন প্রফেসর ডা. মরিস বুকাইলি। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ তখন তিনি। ভিন্ন অবস্থায়। ভিন্ন চেহারায়। ভিন্ন আলোর পথের পথিক হয়ে। বিশ্বাসের হিরম্ময় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত যে পথের আদ্যোপান্ত। যে পথ মানুষকে তুলে নেয় মুক্তির উপলোপল তীরে। যে পথ মানুষকে পরিচিত করে দেয় স্রষ্টার সাথে। অদেখা সম্পর্কের সুতো বেধে দেয় আসল মালিকের সাথে। যে পথ তার পথিকদের পৌঁছে দেয় জান্নাতের সবুজ কান্তিময় প্রান্তরে।
ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তনের পরে এ ঘটনা পরবর্তী ১০ বছর তিনি তার পেশাগত ডাক্তারি প্রাকটিস্ বন্ধ রাখেন এবং সুদীর্ঘ এই সময়টিতে (এক টানা ১০ বছরে) তিনি শিখে নেন আরবী ভাষা। ব্যুতপত্তি অর্জন করেন এই ভাষায়। অত:পর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে প্রমানিত কোনো বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বক্তব্যের বৈপরিত্য রয়েছে কি না তিনি সেদিকে মনযোগী হন। তিনি তার গবেষনার এক পর্যায়ে এমন একটি আয়াত খুঁজে পান যেটি তার অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।, তারপর তিনি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অর্থ বুঝলেন যেটাতে বলা আছেঃকোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবেনা। সম্মুখ হতেও নয়, পশ্চাৎ হতেও নয়; এটা প্রজ্ঞাময় প্রশংসা আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।
১৯৭৬ সালে ডা. মরিস বুকাইলি একটা বই লেখেন যেটা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের টনক নাড়িয়ে দেয়। যেটা বেস্ট সেলার হয়। বইটি প্রায় ৫০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে!!
জ্ঞানী গুনী আর বিজ্ঞানীদের টনক নাড়িয়ে দেয় তার সে অমর বই। বেস্ট সেলারও হয় বইটি। আর এযাবত প্রায় ৫০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয় তার সে বই। বিখ্যাত এ বইটির নামঃ 'বাইবেল, কুরআন এবং বিজ্ঞান' (The Bible The Quran and Science)।
তিনি বইটির মুখপত্রে লিখেন: “These scientific areas which Qur’an established to the exclusion of other Scriptures filled me with deep surprise early on, since it never struck my mind to see such a large amount of scientific issues in such a variable and accurate way that they are a mirror image of what has recently been discovered in a book which has existed for more than 13 centuries.!!
ভদ্রলোকের একটি বিষয় আমার বেশ ভালো লেগেছে। তা হলো- শেষ বয়সে সত্যানুসন্ধান। তিনি নিতান্তই জানার উদ্দেশ্য নিয়েই তা শুরু করেছিলেন। যা তিনি বইটিতে স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন। সে যখন ‘আরবি ভাষা’ শেখা শুরু করে তখন তার বয়স ৫০+ পেরিয়েছে।
এখান থেকে একটি বিষয় শেখার আছে আমাদের। আমরা কুরআন নিয়ে কতটুকু ভাবি? কতটুকু চিন্তাভাবনা করি বা কোন ব্যক্তি যখন কুরআন নিয়ে কিছু (অভিযোগ) বলে তখনই বা কতটুকু চিন্তাভাবনা করি আমরা। ভদ্রলোকের কিন্তু এভাবেই সত্য গ্রহণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি যখন ফিরাউনের আবিষ্কৃত মমি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন, তখন একজন তাকে অবহিত করলেন, কুরআনেও ফিরাউনের কথা বলা রয়েছে। তখন থেকেই শুরু হয় তার সত্যের পথে যাত্রা।