পলাশী যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের কারণ নিয়ে যে সব নতুন ধারনা উঠে আসছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হল, আঠারো শতকের প্রথম দিকে ইউরোপীয় জাহাজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাঙালি ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণীর উথ্থান। মনে করা হচ্ছে, নবাব সিরাজ যদি বাংলার বন্দরে বন্দরে বিদেশী জাহাজের আনাগোনা নিয়ে নজরদারী করতেন তাহলে ইংরেজ মোকাবিলায় তাঁর রাজনৈতিক প্রস্তুতি সুসংহত ও নিশ্ছিদ্র হতে পারত। এই বিচারে ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার কী দরকার’ প্রবাদটির অন্যরকম গুরুত্ব ও আলাদা একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে।
অর্থ
নগণ্য কোনও মানুষ ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে বড় ও জটিল বিষয়ে অহেতুক আগ্রহ দেখালে এই প্রবাদ বাক্যটির প্রয়োগ হয়।
সংস্কৃত উৎস
প্রবাদটির একটি সংস্কৃত পূর্বসূরির সন্ধান মিলেছে যেখানে বলা হচ্ছে, ‘কিমার্দিক বাণিজ্য (আদার ব্যবসায়) বহিত্র চিন্তয়া (বহিত্র অর্থ জাহাজ)’। যদি একেই প্রবাদটির মূল বলে মনে করা হয়, তবে এর বাংলা রূপান্তর যেটা ঘটেছে তার উদ্ভব বাংলার মুসলমান শাসনকালে বলে অনুমান করা যেতে পারে।
কেন এই অনুমান
কারণ বাংলা প্রবাদটির মধ্যে থাকা ‘জাহাজ’ এবং ‘খবর’ ও ‘দরকার’ শব্দত্রয় যথাক্রমে আরবি এবং ফারসি থেকে এসেছে। যতদূর জানা গেছে, ষোলো শতকের আগে বাংলায় আরবি বা ফারসি শব্দের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়নি। তার মানে বাংলা প্রবাদটির বয়স মোটামুটি পাঁচশো বছর। বলা বাহুল্য, সে সময় মুসলিম আধিপত্যের ফলে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রগামী বাণিজ্য জাহাজের চলাচল বেড়ে যায়। আর বাংলার বন্দরেও এদের নিয়মিত বাণিজ্যিক আনাগোনা শুরু হয়।
ব্যাখ্যা
খেয়াল করে দেখুন, আলোচ্য প্রবাদটি থেকে মধ্যযুগীয় বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের একটি স্পষ্ট সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে। আদার ব্যাপারী আর জাহাজের কারবারী দুজনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। তবে আদার ব্যবসা নেহাতই সামান্য উদ্যোগ, কেননা ‘ব্যাপারী’ অর্থে ছোট ব্যবসায়ীর কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাজের খবর বলতে জাহাজের কারবার বা ব্যবসার কথা বলা হচ্ছে, যাতে বড় ঝুঁকি, জবরদস্ত পরিকাঠামো ও বিপুল মূলধনের প্রয়োজন। তাছাড়া সরাসরি ব্যবসা না করেও যিনি জাহাজের খবর নেন তিনিও আর যাই হোন সাধারণ কোনও মানুষ নন। বড় ব্যবসায়ী মহলে তাঁর নিশ্চিত যোগাযোগ আছে, এটাই বোঝানো হচ্ছে। তার ফলে এর সঙ্গে আদার ব্যবসার মতো আটপৌরে লেনদেনের বিশেষ কোনও যোগাযোগ নেই। আসলে এখানে দুই মেরুতে থাকা দুই প্রান্তিক ব্যবসার মধ্যে তুলনা করা হয়েছে মাত্র।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
প্রশ্ন হল, প্রান্তিক একটি ব্যবসার কথা বলতে গিয়ে কেনই বা জাহাজের কথা বলা হল? আসলে এই প্রবাদের মধ্যে সমুদ্র-বাণিজ্যে বাঙালির অংশগ্রহণের একটি তথ্য লুকিয়ে আছে। খুব সহজ করে বললে ‘জাহাজের খবর’ রাখার সাদামাটা অর্থ হল, দেশী-বিদেশী জাহাজের বাংলার বন্দরে আনাগোনা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা। সে সময়ে প্রতি বছর বাংলার বন্দরে গড়ে ২০-২৫টি জাহাজ আনাগোনা করতে দেখা গেছে। তখন বিভিন্ন পণ্যের রফতানির মধ্যেই বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধির খোঁজ মিলত। কারণ তখনও বাংলায় বিশেষ কিছু আমদানি করা হত না। বরং সে সময়ে বাংলার মূল্যবান সুতিবস্ত্র, মসলিন, রেশমি কাপড় বিদেশীদের মুখ্য আকর্ষণ ছিল। এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে সুতো, সোরা, আফিম, তেল, ঘি, চাল ও মসলার মতো কাঁচামালের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। তখন আওরঙ্গজেবের সময়কাল। ভূপর্যটক বার্নিয়ের বাংলা ঘুরে এসে লিখেছিলেন, প্রতি বছর ব্যবসায়ের মূলধন হিসাবে ইউরোপীয় বণিকরা বাংলায় যে সোনা-রুপা নিয়ে আসে, তা এখানেই থেকে যায়। সে সময়ে চালের বিনিময়ে মালদ্বীপ থেকে জাহাজ ভর্তি করে কড়ি আসত। এই কড়ি বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার ও অন্যান্য জায়গায় দেশীয় মুদ্রা ব্যবস্থার সর্বনিম্ন বিনিময় স্তর হিসাবে বৈধ ছিল। ভারথেমা, টোম পিরেস এবং ডুরান্টে বারবোসা বাংলার বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন।
শেষ মন্তব্য
ওপরের সমস্ত আলোচনার পরে চূড়ান্ত পর্বে এটাই বলতে চাইব যে, ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার কী দরকার’ প্রবাদটির অর্থ অনেকটাই গূঢ় কারণ, এর সঙ্গে বাংলার অনেক ইতিহাস ও তৎকালীন অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সরাসরি যুক্ত হয়ে আছে।
কৃতজ্ঞতা- একটি প্রবাদের ইতিবৃত্ত
Tags:
অজানা তথ্য