ব্যাংকিং বা সুদ!

ব্যাংকিং বা সুদ!

ব্যাংকিং বা সুদ। অনেকের প্রশ্ন ব্যাংকিং বা সুদ নিয়ে। এখনকার সময়ে ব্যাংকিং ছাড়া একজন মানুষের জীবনযাপন অনেক কঠিন কিন্তু ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। আসুন দেখি কোরআন কি বলে > সূরা বাকারা, আয়াত-২৭৫ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন কিন্তু সুদকে হারাম করেছেন। খুবই পরিষ্কার সুদ নিষিদ্ধ, তাে সুদ জিনিসটা কী? সূরা নিসা, আয়াত-১৬১ > যারা সুদ(usury) নিচ্ছে তাদেরকে নিষেধ করার পরও এবং মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভােগ করছে, আমি সেসব অবিশ্বাসীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। প্রস্তুত রেখেছি। প্রথমত সুদ (উসারী) কি? জানা জাক। সুদ(usury) হচ্ছে অনৈতিক আর্থিক ঋণব্যবস্থা, যাতে ঋণদাতা অন্যায়ভাবে ধনী হয়। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা বললেন মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভােগকারীদের জন্য। তাে এখানে পরিষ্কার সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঋণদাতা বা ব্যাংকের জন্য। কারণও পরিষ্কার। ঋণগ্রহীতা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূরা আল ইমরান-এর ১৩০ নম্বর আয়াত থেকে আরাে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় , তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। সুরা বাকারা, ২৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে। আর সদাকা করে দেয়া তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে। ইসলামের পূর্বে জাহেলী যুগে ঋণ পরিশোধ না হলে চক্রবৃদ্ধিহারে সূদের উপর সূদ বাড়তে বাড়তে মূলধনে যোগ হত। ফলে সামান্য অর্থ একটি পাহাড় হয়ে দাঁড়াত এবং তা পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ত। মহান আল্লাহ এর বিপরীত নির্দেশ দিয়ে বললেন, যদি ঋণগ্রহীতা আর্থিক সংকটের মধ্যে থাকে, তবে সংকটাবস্থা কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত তাদের সময় দাও। কিন্তু যদি মওকুফ( সাদকা) করে দিতে পারাে তবে তা তােমাদের জন্য কল্যাণকর। এই হচ্ছে সুদ সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ। এসব আয়াত থেকে এটা খুবই পরিষ্কার যে ঋণের অনৈতিক বা অতি উচ্চসুদ গ্রহণ করা কার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে। আল্লাহ সুদকে অচ্ছুত বলেননি যে ব্যাংকের কোনাে সার্ভিস নিতে পারবে না বা ব্যাংকে চাকরি করতে পারবে না। বরং ব্যাংককে বা লোণ দাতাকে বলছে যাতে মানুষের জন্য কষ্ট হয় এমন উচ্চহারে, জবরদস্তিমূলকভাবে সুদ না নেয়।” ইসলামে লোনের বিধান হচ্ছে কর্জে হাসানা, অর্থাৎ লোন পরিশোধের অক্ষম হলে সেটা দান বা সাদকা হিসেবে বিবেচিত হবে। তাহলে এমন শর্তে আপনাকে কি কোন ইসলামী ব্যাংক ঋণ দিবে। আর এমন সুযোগ থাকলে কতজন সেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে। সুতরাং, আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম। এই ব্যবসা বা সুদের পার্থক্য হচ্ছে ইনসাফ। যদি ব্যাংক বা লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ইনসাফের সীমার মধ্যে থাকে (গ্রাহক সেবা জনকল্যাণ) তবে তা ব্যবসা আর যদি উচ্চহারে অন্যায় ভাবে মানুষের উপর অবিচার করে তাহলে তা সুদ বা হারাম এবং এটা অন্যান্য ব্যবসার বেলাতেও প্রযোজ্য । ঋণগ্রহীতা যদি সার্বিক সেবায় সন্তুষ্ট হয় তবে তা হারাম নয়। সুদ হারাম মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভােগ করা অর্থে, এই অন্যায়ের মানদণ্ড হচ্ছে যখন এক পক্ষ নিজেকে বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত মনে করবে। কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে যদি রিকশাওয়ালার পঞ্চাশ টাকার ভাড়া ১০ টাকা দেয় তবে বাকি চল্লিশ টাকা একেবারে সুদের মতােই হারাম। মূল্যবৃদ্ধি ওজনে কম দেয়া ব্যবসায়ী ও সততার জন্য হযরত শোয়াইব আলাই সাল্লাম এর সম্প্রদায় কে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে । সুতরাং ব্যাংক ব্যবসা বা যে কোন লেনদেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে তা হতে হবে। নবীজির সময়কালে বা আমাদের দেশেও যখন ব্যাংকিং সুবিধা সাধারণ মানুষ ছিলনা তখন গ্রামের মহাজনরা সাধারণ মানুষের চরম অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গয়না, আবাদি জমি ইত্যাদি বন্দক রেখে সামান্য কিছু ঋণ দিত । দরিদ্র মানুষেরা সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারত না । কিন্তু চক্রবৃদ্ধি সুদের কারনে ভিটেমাটি ঋণদাতা কে ছাড়তে হতো । এখন তা অনেকটা কমে গেছে । আধুনিক ব্যাঙ্ককিং ব্যবস্থা আসার কারনে । ব্যাংক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণ কোম্পানিগুলাের বিশাল কর্মী বাহিনী আছে, যা পরিচালনার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় । ব্যাংক বা ক্ষুদ্রঋণ কোম্পানিগুলাে মূলত ব্যবসা করছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ, ব্যক্তি বা ব্যাংক জেনারেল বা ইসলামী ঋণদাতা যেই হােক, যদি তা ঋণগ্রহীতার ওপর জুলুম হয় তবে তা হারাম।

কেউ কেউ সুদ ও মুনাফাকে অভিন্ন মনে করে থাকেন।

বর্তমান বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম দ্রুত বিকাশ লাভ করায় সুদ ও মুনাফার বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। কেউ কেউ সুদ ও মুনাফাকে অভিন্ন মনে করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে সুদ ও মুনাফা এক নয়। এ দুয়ের মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক অনেক পার্থক্য রয়েছে। ‘সুদ’ উর্দু শব্দ। আল কোরআনে ‘রিবা’ সুদের প্রতিশব্দ। অনেকের দৃষ্টিতে রিবা ও সুদ সমার্থবোধক বলে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে ‘রিবা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। সুদ এর একাংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)|


রিবার ধরন : অন্যদিকে ‘রিবা’র পারিভাষিক অর্থ বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে বেশি পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাকেই বলে সুদ। আবার একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয়, তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়।

মুনাফার পরিচয় : ‘রিবহুন’ শব্দের প্রতিশব্দ হলো লাভ বা মুনাফা। ইসলামী শরিয়তে মুনাফা হচ্ছে ‘সম্পদের এমন প্রবৃদ্ধি, যা কোনো অর্থনৈতিক কারবারে সম্পদ বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত হয়। উদ্যোক্তা প্রথমে বিনিয়োগকৃত অর্থকে পণ্যে রূপান্তর করে, অতঃপর ওই পণ্য বিক্রয় করে পণ্যকে অর্থে রূপান্তর করে। এভাবে রূপান্তরিত অর্থ বিনিয়োগকৃত অর্থের তুলনায় বেশি হলে উদ্যোক্তা লাভ পায় আর প্রাপ্ত অর্থ আগের তুলনায় কম হলে তার পুঁজি কমে যায় বা তার লোকসান হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ব্যবসায়ী ১০ হাজার টাকার পণ্য ক্রয় করে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করল। এখানে পুঁজি বৃদ্ধি পেয়েছে দুই হাজার টাকা। পুঁজির এ বর্ধিত অংশ হলো মুনাফা বা লাভ। আর পুঁজি কমে গেলে তাকে বলা হতো লোকসান। ব্যবসায়ে লাভ-লোকসানের ক্ষেত্রে পুঁজিকে পণ্যে রূপান্তর ও শ্রম বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও গ্রহণ করতে হয়।

সুদ ও মুনাফার প্রধান পার্থক্য : এখানে উল্লেখ্য যে সুদের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি পায়, আবার ব্যবসায়ের মাধ্যমেও তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সুদের মাধ্যমে সুদ দাতা লাববান হয় । এবং সুদ গ্রহিতা ক্ষতি গ্রস্থ হয় একাই ।

মুনাফা হচ্ছে আপনি যাকে মূলধন দিলেন সর্ত সাপেক্ষে যে সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে । সেখান থেকে সে আপনাকে আপনার মূলধন ফিরিয়ে দিবে অতিরিক্ত কিছু অর্থ সহ । তবে এক্ষেত্রে যদি ঋণ গ্রহিতা কোন কারনে খতি গ্রস্থ হয় তখন তাকে অতিরিক্ত সেময় দিতে হবে আপনার মূল ধন ফিরিয়ে দিতে । আর আপনার জন্য কল্যাণ কর হবে যদি তখন তা তাকেমাফ করে দেন ( সাদকা করে দেন )

আরেকটি হচ্ছে পরিকল্পিত কাজে আপনি আপনার মূলধন দিলেন সর্ত সাপেক্ষে এবং ব্যবসার লাব ও লস ২ তেই আপনি অংশীদার হবেন ।

তবে তা ইসলামে হালাল ।

সহজ করে বলতে গেলে ঃ কাউকে নগত অর্থ দিয়ে অতিরিক্ত কোন অর্থ দেওয়া হল সুদ ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে ১০ টাকা ধার দেয় এ শর্তে যে এক দিন পরে তাকে ১১ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত এক টাকা সুদ, যা ইসলামী শরিয়তে হারাম।


বিপরীত পক্ষে, কেউ যদি হাট থেকে ১০ টাকা দিয়ে এক কেজি বেগুন কিনে অন্য বাজারে গিয়ে ১৫ টাকায় বিক্রি করে, তাহলে যে পাঁচ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাকে সুদ বলা যাবে না। এই পাঁচ টাকা লাভ, যা হালাল বলে গণ্য হবে।

পরিশেষে সুদ ও মুনাফার পার্থক্য সংক্ষেপে বলা যায় এভাবে—মুনাফা বেচাকেনা বা ব্যবসার স্বাভাবিক ফল থেকে আসে। বিপরীতপক্ষে, সুদ অর্জিত হয় ঋণের ওপর। মুনাফা উদ্যোক্তার পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের ফল; কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণ করে না, অর্থ ধার দেয় মাত্র। মুনাফা অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত, কিন্তু সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। মুনাফায় ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়, আর সুদে তা গ্রহণ করতে হয় না। ব্যবসায় কোনো পণ্যের ওপর লাভ একেবারে নির্ধারণ করা যায়; কিন্তু একই মূলধনের ওপর বারবার সুদ নির্ধারণ ও আদায় করা যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post