আরবিতে পুলকে বলা হয় সিরাত। এটি হাশরের ময়দান থেকে জাহান্নামের ওপর দিয়ে জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এবং অনেক ভয়ঙ্কর হবে। ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে পুলসিরাত দেখিয়ে দিয়ে বলবেন, ‘এটা তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছার পথ। এ পুল পেরিয়েই তোমাদের যেতে হবে।’ কিন্তু সবার জন্য পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। পাপী বান্দারা সেটাকে চুল থেকেও চিকন দেখতে পাবে। তাদের জন্য সেটি হবে অত্যন্ত ধারালো। তারা ওই পুলে আরোহণ করা মাত্রই তাদের পা কেটে নিম্নস্থ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আর নেককারদের জন্য হবে সুপ্রশস্ত সুগম পথ। তারা তাদের নেকির তারতম্য অনুযায়ী গতিতে জান্নাতে পৌঁছে যাবে।
▪আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে বলেছেন, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের শপথ! (মহাবিচার দিবসে) আমি অবশ্যই ওদেরকে এবং ওদের প্ররোচক শয়তানদেরকে একত্র করে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চারপাশে জড়ো করব। এরপর প্রত্যেক দলের মধ্য থেকে দয়াময়ের সবচেয়ে অবাধ্যদের আলাদা করা হবে। তাছাড়া আমি তো জানিই, ওদের মধ্যে কারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি যোগ্য। জাহান্নাম সবার সামনেই দৃশ্যমান হবে। এটা তোমার প্রতিপালকের সিদ্ধান্ত। পরে আল্লাহ-সচেতনদের আমি উদ্ধার করব। আর জালেমদের নতজানু অবস্থায় সেখানে নিক্ষেপ করব।’ (সুরা মারয়াম : ৬৮-৭২)
▪কেমন হবে পুলসিরাতঃ-
“পুলসিরাত হবে অনেক ভয়ঙ্কর। চুলের মতো সূত্র ও চিকন হবে। তরবারির মতো ধারালো হবে। নিচে থাকবে জাহান্নাম। দুই পাশে থাকবে লোহার তপ্ত শলাকা। কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকবে না। যার যার আমলের আলো দিয়ে সে পথ অতিক্রম করতে হবে। হজরত আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! পুলসিরাত কেমন হবে? নবীজি বললেন, দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটা বিশিষ্ট হবে, যা নাজ্দ দেশের সাদান বৃক্ষের কাঁটার মত হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো।
তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। একবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি, সে হেঁচড়িয়ে কোন ভাবে পার হয়ে আসবে।
(বুখারি : ৭৪৩৯; মুসলিম : ১৮৩)।
----
▪যাদের আমলের পরিমাণ বেশি তারা অতিদ্রুত চোখের পলকের মতো পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। আর যার আমল কম তারা হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে।
পুলসিরাত অতিক্রমের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা হাদিদ এ বলেছেনঃ
সেদিন আপনি দেখবেন মুমিন নর-নারীদেরকে তাদের সামনে ও ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে।(১) বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই তো মহাসাফল্য। [2] (সুরা হাদিদ : ১২)
[1] এটা হাশরের ময়দানে পুলসিরাতে হবে। এই জ্যোতি তাদের ঈমান ও সৎকর্মের প্রতিদান হবে। এরই আলোতে তারা (জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুলে) জান্নাতের পথ অতি সহজে অতিক্রম করে নেবে। ইবনে কাসীর ও ইবনে জারীর প্রভৃতি ইমামগণ وَبِأَيْمَانِهِمْ এর অর্থ এই বর্ণনা করেছেন যে, তাদের ডান হাতে থাকবে তাদের আমলনামা।
[2] এ কথা বলবেন সেই ফিরিশতাগণ, যাঁরা তাদের অভ্যর্থনার জন্য সেখানে উপস্থিত থাকবেন। তাফসীরে আহসানুল বায়ান]
▪আল্লাহ তায়ালা আরোও সূরা হাদিদ এ বলেছেনঃ
“সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি। বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও নূরের সন্ধান কর। তারপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, যার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি।(সুরা হাদিদ : ১৩)
▪আল্লাহ তায়ালা সূরা আন-নূর এ বলেছেনঃ
“অতঃপর তোমরা কবর থেকে হাশরের ময়দানে স্থানান্তরিত হবে। হাশরের বিভিন্ন মনযিল ও স্থান অতিক্রম করতে হবে। এক মনযিলে আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে কিছু মুখমণ্ডলকে সাদা ও উজ্জ্বল করে দেয়া হবে এবং কিছু মুখমণ্ডলকে গাঢ় কৃষ্ণবৰ্ণ করে দেয়া হবে। অপর এক মনাযিলে সমবেত সব মুমিন ও কাফেরকে গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলবে। কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না। এরপর নূর বণ্টন করা হবে। প্রত্যেক মুমিনকে নূর দেয়া হবে। মুনাফিক ও কাফেরকে নূর ব্যতীত অন্ধকারেই রেখে দেয়া হবে। আর এ উদাহরণই আল্লাহ তাঁর কুরআনে পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “অথবা তাদের কাজ গভীর সাগরের তলের অন্ধকারের মত, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আল্লাহ যাকে নূর দান করেন না তার জন্য কোন নূরই নেই।” [সূরা আন-নূর: ৪০]
-অত:পর যেভাবে অন্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান ব্যক্তির চোখ দ্বারা দেখতে পায় না তেমনি কাফের ও মুনাফিক ঈমানদারের নুর দ্বারা আলোকিত হতে পারবে না। মুনাফিকরা ঈমানদারদের বলবে, “তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি।” এভাবে আল্লাহ্ মুনাফিকদেরকে ধোঁকাগ্ৰস্থ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “তারা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় আর আল্লাহ্ তাদেরকে ধোঁকা দিবেন।” [সূরা আন নিসা: ১৪২] তারপর তারা যেখানে নূর বন্টন হয়েছিল সেখানে ফিরে যাবে, কিন্তু উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, ওটার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি। এভাবেই মুনাফিক ধোঁকাগ্ৰস্ত হতে থাকবে। আর মুমিনদের মাঝে নূর বন্টিত হয়ে যাবে। [ইবনে কাসীর]
-আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, প্রত্যেক মুমিনকে তার আমল পরিমাণে নূর দেয়া হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নূর থাকবে; তাও আবার কখনও জ্বলে উঠবে এবং কখনও নিভে যাবে। [ইবনে কাসীর]
[তাফসীরে জাকারিয়া]
▪আল্লাহ তায়ালা আরোও সূরা হাদিদ এ বলেছেনঃ
“মুনাফিকরা মুমিনদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে, আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্ৰস্ত করেছ। আর তোমরা প্ৰতীক্ষা করেছিলে, সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং অলীক আকাংখা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, অবশেষে আল্লাহর হুকুম আসল।(১) আর মহাপ্ৰতারক(২) তোমাদেরকে প্ৰতারিত করেছিল আল্লাহ সম্পর্কে।(সুরা হাদিদ : ১৪)
-এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, সেটিই তোমাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা তো আল্লাহকে তোমাদের অভিভাবক বানাওনি যে, তিনি তোমাদের তত্ত্বাবধান করবেন। এখন জাহান্নাম তোমাদের অভিভাবক। সে-ই তোমাদের যথোপযুক্ত তত্ত্বাবধান করবে। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]
▪সুতরাং আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা কুফরী করেছিল তাদের কাছ থেকেও নয়। জাহান্নামই তোমাদের আবাসস্থল, এটাই তোমাদের যোগ্য(১); আর কত নিকৃষ্ট এ প্রত্যাবর্তনস্থল! (সুরা হাদিদ : ১৫)
▪আল্লাহ যেন আমাদের সকল গুনাহ মাফ করে খুব সহজে পুলসিরাত পার করার তাওফিক দান করে। আমিন।