হিন্দু ধর্মের পরিচয় !

 একজন মুসলমান হিসেবে আমি সাদামাটা ভাবে হিন্দু ধর্মের ব্যাপারে কিছু বলছি। ভুল হলে বলবেন। সংশোধন করে দিবো।হিন্দু ধর্ম বলতে ভারতের মানুষদের হাজার বছরের জীবানাচরনকে বুঝায়। সেই ভারত একসময় ' ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ' মিলে এক ভারতবর্ষ ছিলো। "হিন্দু" শব্দটি বহিরাগতরা হিন্দুদের দিয়েছে। মূলত সিন্ধু নদের তীরের মানুষদের 'হিন্দু' বলা হয়। সেই হিসেবে পাকিস্তানের মুসলমানরাও জাতিতে হিন্দু জাতি, বাংলাদেশি মুসলমানেরাও জাতিতে হিন্দু জাতি।

হিন্দু ধর্মের কোনো একজন প্রতিষ্ঠাতা নেই। ভারতের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে হিন্দু 'সনাতন' ধর্ম। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের জীবনাচরনে হিন্দু ধর্মের প্রভাব ব্যাপক। একজন বাংলাদেশি মুসলিম হিসেবে আমি হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করি। ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম দুই ধর্মকেই শ্রদ্ধা করি।

হিন্দু ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। প্রাচীন সমাজের মুনি ঋষিরা ধ্যান সাধনা করে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে ঈশ্বরের যোগসূত্র স্থাপন করে যে জীবনব্যবস্থা প্রনয়ন করেছেন সেটাই সনাতন হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্মের মূল আদি গ্রন্থ বেদগ্রন্থ। এই বেদগ্রন্থ মানবরচিত তবে ঈশ্বর থেকে অনুপ্রানিত। আব্রাহামীয় ধর্মের গ্রন্থগুলো যেমন সরাসরি ঈশ্বর থেকে এসেছে বলা হয় হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলো সরাসরি ঈশ্বর থেকে কোনো ফেরেশতার মাধ্যমে আসে নি। প্রাচীন মনিষীরা ধ্যানরত অবস্থায় ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসেন এবং ঈশ্বর থেকে অনুপ্রানিত হয়ে নিজেরাই বেদগ্রন্থ রচনা করেন। এইসব বেদগ্রন্থে মনিষীদের নিজেদের কথাও আছে এবং ঈশ্বর কর্তৃক আধ্যাত্বিকতা অর্জনের পরে ঐশ্বরিক কথাও আছে।

হিন্দু ধর্মের পরমেশ্বর বা পরম ঈশ্বর হচ্ছেন ব্রহ্ম। হিন্দু ধর্মের ঈশ্বর-চূড়া বা ঈশ্বর-মাথা হচ্ছেন ব্রহ্ম। জগতের সবকিছুর উৎস ব্রহ্ম । ব্রহ্ম নিরাকার কিন্তু সাকার রূপে তিনি দেবতা ও দেবী হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান থাকেন।

পরমেশ্বর ব্রহ্মর প্রতীক হচ্ছে ওঁ ( উচ্চারনঃ অ…উ… ম)। এটি একটি পবিত্র শব্দ। জীবাত্মা পরমেশ্বর ব্রহ্মর সাথে এক হয়ে যাওয়া বুঝাতে এই পবিত্র প্রতীক ব্যবহার করা হয়।

এক ফোঁটা জল বিশাল সাগরে মিলে গিয়ে ঐ বিশাল সাগরের রুপ ধারণ করে, ঠিক তেমনি সকল দেব-দেবী মিলিত হয়ে পরমেশ্বর ব্রহ্মর রূপধারণ করেন।

পরমেশ্বর ব্রহ্মর সাকার রূপের প্রধান রূপ তিনটি। প্রথম রূপ ব্রহ্ম দেবতা। যার কাজ শুধু সৃষ্টি করা। সৃষ্টি করেই উনার কাজ শেষ। দেবতা ব্রাহ্মার আরাধনা কম করা হয় কারন উনার কাজ শুধু সৃৃৃষ্টি। রক্ষণাবেক্ষণ করেন আরেক দেবতা বিষ্ণু। ব্রহ্মর কাজ যেখানে শেষ বিষ্ণুর কাজ সেখানে শুরু। তিনি জগতের সব কিছুর রক্ষাকর্তা। বিষ্ণু অনেক অবতার ধারণ করেন জগতের সবকিছুকে রক্ষা ও পালন করতে। সেই অবতার রূপ হচ্ছে রাম, কৃষ্ণ ও আরো অনেক দেবতা। তবে পরমেশ্বর ব্রহ্মার সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ হচ্ছে শিবের রূপ। তিনিই প্রলয়কর্তা সর্বশক্তিধর মহাদেব শিব।

জগত চলে নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতিতে। সৃষ্টির পরে রক্ষনাবেক্ষন এবং এরপরে প্রলয় বা ধ্বংস এবং আবার নতুন করে সৃৃষ্টি। এভাবেই জগত চলছে। এর ব্যাতয় প্রকৃৃ্তির নিয়ম বিরুদ্ধ। শিব এই কাজটির দায়িত্বে আছেন। শিব জগতের সবকিছু এক নিমেষেই ধ্বংস করে দিতে পারেন। তাই শিবের শক্তি অন্য দেবতাদের চেয়ে অনেক বেশি। এই শক্তির রূপকে শিবলিঙ্গ পূজার মাধ্যমে আরাধনা করা হয়।

এই তিন প্রধান দেবতার স্ত্রী রূপ হচ্ছেন যথাক্রমে স্বরস্বতী দেবী যিনি ব্রহ্মর স্ত্রী, লক্ষ্মী দেবী যিনি বিষ্ণুর স্ত্রী ও পার্বতী দেবী যিনি শিবের স্ত্রী। নারী-পুরুষ মিলেই জগতের সবকিছু। দেবতাকে সম্পূর্ন করেছে তাঁর অর্ধাঙ্গিনী দেবী। এই দেব-দেবীদের সবার উৎস ঐ পরমেশ্বর ব্রহ্মা। তাঁরই সাকার রূপ এনারা। এই প্রধান দেবীদের অবতার রূপ হচ্ছেন দূর্গা, কালি সহ আরো অনেক দেবী।

পরমেশ্বর ব্রহ্ম যেহেতু নিরাকার তাই সাধারণ হিন্দুরা ঈশ্বরের সাকার রূপ দেব -দেবীর পূজার মাধ্যমে পরমেশ্বর ব্রহ্মের পূজা করে থাকেন। সবকিছুর উৎস ব্রহ্ম আবার সবকিছু সেই পরমেশ্বরের কাছেই বিলীন হবে। তাই হিন্দু ধর্ম মতে পরমেশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তিনি গরুর মধ্যেও আছেন, তিনি মানুষের মধ্যেও আছেন। তিনি তার সৃষ্টির সবকিছুতে বিরাজমান। তাই ভক্ত যদি গরুকেও পরেমেশ্বর ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের রূপ ভেবে পূজা করে তবে সেটাও ব্রহ্ম গ্রহণ করেন, কারন তিনি সর্বত্র দেব-দেবী হয়ে বিরাজ করছেন।

হিন্দু ধর্মের বেদ, পুরাণগ্রন্থ ছাড়াও আরো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে রামায়ন, মহাভারত ও শ্রীমদ্ভাগবতগীতা।

রামায়ন হচ্ছে রামের যুগের কাহিনী। সেই সময়ে রাম কিভাবে রাবণের কাছ থেকে নিজ স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করে দুষ্টের দমন করে শিষ্টের পালন করেছেন সেই কাহিনীর পৌরাণিক রূপ হচ্ছে রামায়ন।

মহাভারত হচ্ছে ধর্মযুদ্ধের কাহিনী। কৃষ্ণ এখানে অন্যতম চরিত্র। যিনি রাম , তিনিই কৃষ্ণ। উনারা দুজনই বিষ্ণু দেবতার অবতার। মানে উনারা এক যুগে ছিলেন রাম, এক যুগে কৃষ্ণ। হরে কৃষ্ণ, হরে রাম। জয় শ্রী রাম, জয় শ্রী কৃষ্ণ হিন্দু ধর্মের দুটি বিশেষ ধ্বনি।

মহাভারতের যুগে ভগবান শ্রীকৃৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে একই বংশের পান্ডব ও কৌরব দলের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে পান্ডবদের পক্ষ নিয়ে উনার শিষ্য অর্জুনকে নির্দেশ দেন অধর্মের প্রতীক কৌরবদের ধ্বংস করতে। সেই সময় কৃষ্ণের বাণীর সন্নিবেশ হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবতগীতা। ভগবান শ্রীকৃৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ব্রহ্মর অন্যতম গুনবাচক প্রকাশ। ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও শ্রীকৃৃষ্ণ এক ও অভিন্ন স্বত্তা বিধায় হিন্দুরা ঈশ্বর বলতে ভগবান শ্রীকৃৃষ্ণকেই বুঝিয়ে থাকেন। ঈশ্বর এক কিন্তু তাঁর নাম অনেক। কেউ বলে ব্রহ্ম, কেউ বলে রাম, কেউ বলে শ্রীকৃৃষ্ণ, কেউ বলে শিব। সবাই ঐ এক পরম আত্মার বিভিন্ন গুনের প্রকাশ। যে নামেই পরমেশ্বরকে ডাকা হোক না কেনো সবই ঈশ্বর গ্রহন করেন এই হচ্ছে হিন্দুদের বিশ্বাস।

এই হচ্ছে মোটামুটি হিন্দু ধর্মের পরিচিতি। আশাকরি একটা ধারণা পেয়েছেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post