অনেকের মনে দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, যেসকল হাদীস সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নেই তা হয়তো সহীহ নয় কিংবা সহীহ হলেও এই দুই কিতাবের সহীহ হাদীসের নয়। এ কারণে কোনো বিষয়ে হাদীস পেশ করা হলে বলে, বুখারীতে দেখান, মুসলিমে দেখান। কিংবা বলে, বুখারী-মুসলিমে এর বিপরীত যে হাদীস আছে তা অধিক সহীহ। সুতরাং ঐ হাদীসের উপর আমল করা উচিত এবং এটা বাদ দেওয়া উচিত!
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম দু’জনই পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের ‘কিতাবুস সহীহ’তে যে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তা সব সহীহ।
তবে কেউই এমন দাবী করেননি যে, সকল সহীহ হাদীস তাঁরা তাঁদের কিতাবে একত্র করেছেন বা একত্র করার ইচ্ছা করেছেন ৷
ইমাম ইবনে কাছীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
إن البخاري ومسلماً لم يلتزما بإخراج جميع ما يحكم بصحته من الأحاديث، فإنهما قد صححا أحاديث ليست في كتابيهما، كما ينقل الترمذي وغيره عن البخاري تصحيح أحاديث ليست عنده، بل في السنن وغيرها
অর্থাৎ নিশ্চয় ইমাম বুখারী ও মুসলিম তারা সকল সহীহ হাদীসকে তাদের কিতাবে একত্র করাকে আবশ্যক করে নেননি। তারা উভয়ে এমন অনেক হাদীসকেই সহীহ বলেছেন, যা তাদের কিতাবে নেই। যেমন ইমাম বুখারী নিজেই সহীহ বলেছেন এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন ইমাম তিরমিজী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ। অথচ সেসব হাদীস ইমাম বুখারীর কিতাবে পাওয়া যায় না। বরং তা রয়েছে সুনান ও অন্যান্য গ্রন্থসমূহে। [ইখতিছারু উলুমিল হাদীস-১/২৫]
ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ নিজেই বলেছেন,
مَا أَدْخَلْتُ فِي كِتَابِي (الْجَامِعِ) إِلَّا مَا صَحَّ، وَتَرَكْتُ مِنَ الصِّحَاحِ لِحَالِ الطُّولِ
অর্থাৎ ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আমি আমার কিতাবে [সহীহ বুখারীতে] সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস আনিনি। কিন্তু আমি অনেক সহীহ হাদীস আমার কিতাবের কলেবর বড় হবার শংকায় বাদ দিয়েছি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/১৯]
ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-
لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا، وما تركت من الصحيح أكثر.
অর্থাৎ আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।[শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা,১৬০- ১৬৩]
তেমনি একথাও সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কিতাব তাঁরই উস্তাদ ইমাম আবু যুরআ রাযী এবং ইবনে ওয়ারা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হাতে পৌঁছলে তাঁরা বলেছিলেন,
ان هذا يطرق لاهل البدع علينا
অর্থাৎ তুমি সহীহ নামে কিতাব লিখে বিদআতীদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। (যখন তাদের সামনে কোনো সহীহ হাদীস পেশ করা হবে তখন তারা এই বলে প্রত্যাখ্যান করবে যে, এটি তো সহীহ মুসলিমে নেই।)
ইমাম মুসলিম তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন যে,
انما اخرجت هذا من الحديث الصحيح ليكون مجموعا عندي وعند من يكتبه عني فلا يرتاب في صحتها ولم اقل ان ما سواه ضعيف
অর্থাৎ আমি তো শুধু আমার ও আমার নিকট যারা হাদীস শিখতে আসবে তাদের স্মরণ রাখার সুবিধার্থে কিছু হাদীস সংকলন করেছি। আমি বলিনি যে, এই সংকলনের বাইরের সকল হাদীস দুর্বল; বরং আমি শুধু এটুকু বলি যে, এই সংকলনের হাদীসগুলো সহীহ। [তারীখে বাগদাদ ৪/২৭৪, আলইমামু ইবনু মাযাহ ও কিবুহুস সুনান ১১০-১১১]
তখন ইবনে ওয়ারা তার ওজর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে হাদীস শুনান।
এই ঘটনা থেকে যেমন বোঝা যায়, ইমাম মুসলিম রাহ. সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি তেমনি এ কথাও বোঝা যায় যে, কোনো সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেশ করা হলে ‘এ তো সহীহ মুসলিমে নেই’ বলে তা ত্যাগ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকা হতে পারে না। একই কথা সহীহ বুখারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আলমুসতাখরাজ আলা সহীহি মুসলিম’’-এ একটি হাদীসের মান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
"فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى و إلى طريقتهما أقرب"
অর্থাৎ বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ত্যাগ করেছেন, যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী। [আলমুসতাখরাজ ১/৩৬ ]
ইমাম আবু বকর ইসমায়িলী রহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ আলা সহীহিল বুখারী’তে হাম্মাদ ইবনে সালামা থেকে ইমাম বুখারীর রেওয়ায়েত না করার প্রসঙ্গে বলেছেন,
‘বুখারী তো তাঁর মানদন্ডে উত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো জয়ীফ কিংবা সেগুলোকে তিনি বাতিল করতে চান। তো হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত না করার বিষয়টিও এরকমই।’ [আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী ৩/৩৫৩]
ইমাম মুসলিম আরো বলেছেন,
لَيْسَ كُلُّ شَيْءٍ عِنْدِي صَحِيحٌ وَضَعْتُهُ هَاهُنَا – يَعْنِي فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ –
অর্থাৎ (ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ বলেছেন) আমার কাছে “সহীহ” হিসেবে গণ্য সব হাদীসই আমার কিতাবে আনিনি। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
এ বিষয়ে ইবনুস সালাহ রহঃ এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য,
وَقَدْ قَالَ الْبُخَارِيُّ: ” أَحْفَظُ مِائَةَ أَلْفِ حَدِيثٍ صَحِيحٍ، وَمِائَتَيْ أَلْفِ حَدِيثٍ غَيْرِ صَحِيحٍ “، وَجُمْلَةُ مَا فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ سَبْعَةُ آلَافٍ وَمِائَتَانِ وَخَمْسَةٌ وَسَبْعُونَ حَدِيثًا بِالْأَحَادِيثِ الْمُتَكَرِّرَةِ. وَقَدْ قِيلَ: إِنَّهَا بِإِسْقَاطِ الْمُكَرَّرَةِ أَرْبَعَةُ آلَافِ حَدِيثٍ،
অর্থাৎ ইমাম বুখারী বলেছেন, আমার এক লাখ সহীহ হাদীস মুখস্ত। আর দুই লাখ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্ত।
অথচ সহীহ বুখারীতে তাকরার [এক বর্ণনা একাধিকবার উল্লেখকরণ]সহ মোট হাদীস সংখ্যা হল,সাত হাজার, দুইশত পঁচাত্তরটা। আর কেউ বলেছেনঃ তাকরার ছাড়া হাদীস সংখ্যা হল চার হাজার। [মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ-১/২০]
এখন প্রশ্ন হল, ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, তার সহীহ হাদীসই মুখস্ত ছিল এক লাখ। বুখারীতে উল্লেখ আছে মাত্র নয় হাজার। তাও তাকরারসহ। বাকি একান্নবই হাজার সহীহ হাদীস গেল কোথায়?
ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহিমাহুমাল্লাহ তাদের কিতাবে সহীহ হাদীস এনেছেন কথা সত্য। কিন্তু সব হাদীস আনার দাবীও করেননি। আনতে পারেনওনি। তা সম্ভবও নয়। তাহলে কিতাব আরো বিশাল বড় হয়ে যেতো।
শুধু মুসতাদরাকে হাকিমেই এ পর্যায়ের হাদীস, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারের কাছাকাছি। [আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ ]
মুসনাদে আহমদ এখন ৫২ খন্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আরনাউত ও তার সহযোগীরা সনদের মান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। মারকাযুদ দাওয়ার উচ্চতর হাদীস বিভাগের একজন তালিবে ইলম শুধু প্রথম চৌদ্দ খন্ডের রেওয়ায়েতের হিসাব করেছেন।
দেখা গেছে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ-এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোর মধ্যে :
➡বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুযায়ী ৪০১টি,
➡শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ৬৪টি,
➡শুধু মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ২১৫টি হাদীস রয়েছে।
➡এছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগায়রিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি ও হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী হাদীস ৬১৫টি।
এসব সংখ্যা স্বতন্ত্র-অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি বা শাহেদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।
➡ইমাম তহাবী রহ. এর ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ও তাখরীজসহ ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
➡এর মধ্যে নমুনা হিসাবে শুধু দুই খন্ডের হাদীস ও আছার দেখা হয়েছে তো
➡বুখারী-মুসলিম উভয়ের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীস পাওয়া গেছে ২২২টি,
➡বুখারী-মুসলিম কোনো একজনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীসসংখ্যা ১৪৬টি।
➡এর মধ্যে ৪৬ টি এমন যে, তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী বুখারী-মুসলিমে তার কোনো মুতাবি-শাহিদ (সমর্থক বর্ণনাও) নেই।
এ ছাড়া এই দুই খন্ডে সহীহ লিযাতিহী হাদীস ২৬৪ টি,
➡সহীহ লিগায়রিহী ১২১টি,
➡হাসান লিযাতিহী ৯৪টি ও
➡হাসান লিগায়রিহী রয়েছে ১৩টি।
➡শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ‘সিফাতুস সালাহ’র (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) উপর যে কিতাব লিখেছেন তাতে
➡ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬ টি হাদীস রয়েছে এবং
➡সহীহ বুখারী-সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানের কিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬ টি।
স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. তাদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন বা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নেই।
কারো সন্দেহ হলে ‘জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি খুলে দেখতে পারেন।
জামে তিরমিযী খুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন, যা সহীহ বুখারীতে নেই।
তো এই সকল নিশ্চিত ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রহণ করতে শুধু এ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া যে, তা বুখারী, মুসলিমে নেই, অতি সত্হী ও অগভীর চিন্তা নয় কি?
কিছু সহীহ হাদীসের কিতাব যাতে এমন সহীহ হাদীস রয়েছে যা বুখারী মুসলিমে নেই ৷
➡বাকি সহীহ হাদীসগুলো,
(১) মুস্তাদরাকে হাকেম (২) সহীহ ইবনে আওয়ানা (৩) সুনানে দারা কুতনী (৪) সহীহ ইবনে হিব্বান (৫ ) সহীহ ইবনে খুজাইমা (৬ ) সুনানে তিরমিজী (৭) সুনানে আবু দাউদ (৮) জামে তিরজিমী (৯ ) সুনানে নাসায়ী (১০) সুনানে ইবনে মাজাহ (১১) মুসনাদুল হুমায়দী (১২) মুসনাদুল বাজ্জার (১৩) মুসনাদে আহমাদ (১৪ ) সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী (১৫) সুনানে সুগরা লিলবায়হাকী (১৭) শুয়াবুল ঈমান, তাহাবী শরীফ (১৮ ) মুসনাদে ইবনুল জা’দ ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহে রয়েছে।
এসব কিতাবের সব হাদীসই সহীহ নয়। কিছু হাদীস জঈফ বা জালও আছে। কিন্তু অধিকাংশ হাদীসই সহীহ কিংবা হাসান।
বুখারী মুসলিম ছাড়াও সহীহ হাদীসের উপর অনেক হাদীস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বুখারী ও মুসলিমের মূলনীতি অনুপাতে যেসব হাদীস সহীহ। এমন হাদীস যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম আনেননি। কিন্তু তা বুখারী ও মুসলিমে আনা হাদীসের মতই সহীহ। এমন হাদীস একত্র করে “মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন” নামে আলাদা কিতাবও রচিত হয়েছে। যা এক সুবিশাল কিতাব। যে কিতাবে আট হাজার আটশত তিনটি হাদীস রয়েছে। যার কোনটিই বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হয়নি।