কুরআনে নারীদের কথা


কুর'আনের আয়াতগুলি কাগজে লেখা কিছু কথা ছিলো না,আয়াতগুলি ছিলো সমাজ সংস্কারের বিপ্লবী হাতিয়ার। সেগুলি ছিলো আইন। নিচে তেমন কিছু আয়াতের উদাহরণ দেয়া হলো-

(১) ইসলাম পূর্ব যুগের দলিত সমাজে কন্যাসন্তান ছিলো অনাকাংখিত ও উদ্বেগের বিষয়। ভূমিষ্ঠ কন্যাসন্তানকে লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। এই নিদারুণ ভয়ংকর অন্যায় কর্মটি কুর'আনের দু'টি আয়াতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।-

-

'যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মুখ কালো হয়ে যায়, আর নিজের ভেতরে অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে।'

'সে তখন লজ্জায় লোক সমাজের কাছ থেকে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখে, কারণ দুঃসংবাদ শুনে সে ভাবে, অপমান সহ্য করে (অসন্মানের সাথে) তাকে বেঁচে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলবে! নিশ্চয় তাদের বিচার বড় নিকৃষ্ট!' (কুর'আন,১৬/৫৮,৫৯)

-

(২) ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের গোত্রীয় সমাজে নারীদের প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর একটি প্রথা চালু ছিলো। তালাক দেয়ার মতো বিবাহিত পুরুষরা তাদের স্ত্রীদেরকে 'তুমি আমার মায়ের মতো' এ কথা বলে স্ত্রীকে অবৈধ ঘোষণা করতো। স্ত্রী বয়স্ক হলে, তার প্রতি আকর্ষণ হারালে, সন্তান দানে অক্ষম হলে, এমন আচরণ করা হতো বলে প্রতীয়মান হয়। এটি তালাকের মতো এক ধরণের রীতি হলেও স্ত্রীদের অন্যত্র বিয়ে করার অধিকার বা সামাজিক মর্যাদা ছিলো না। ইসলাম আবির্ভাবের পর এই রীতি বন্ধ হয়ে যায় মুসলমান সমাজে। এই অসাধ্য সাধিত হয় কুর'আনের কয়েকটি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে।

-

এ সংক্রান্তে সুরাহ মুজদালার প্রথম আয়াতে আছে একটি ঘটনার উল্লেখ, যেখানে অবমাননার শিকার একজন মহিলা অভিযোগ নিয়ে এসেছিলো নবী মুহাম্মদের কাছে-

'তোমার কাছে যে নারী তার স্বামীর ব্যাপারে বাদানুবাদ করছিলো, আর আললাহ'র কাছে অভিযোগ জানাচ্ছিলো, আললাহ তার কথা শুনেছেন। আললাহ তোমাদের দুজনের কথাই শুনেছেন। নিশ্চয় আললাহ সব শোনেন,সব দেখেন।'(কুর'আন,৫৮/-১)

-

তাফসির ও সংশ্লিষ্ট হাদিস পর্যালোচনা করে উল্লেখিত ঘটনাটি সম্পর্কে যে টুকু জানা যায় তা হলো, এক বিবাহিত বয়স্ক নারী নবীর কাছে এসে অভিযোগ করছিলেন, তার স্বামী এতোদিন তার সম্পদ ব্যবহার করেছেন, তার যৌবন উপভোগ করেছে্ন, তার গর্ভের সন্তান পেয়েছেন, কিন্তু যখন আজ তার বয়স হয়ে গেছে, যখন তিনি সন্তান ধারণে অক্ষম, তখন তাকে 'তুমি আমার মায়ের মতো, তাই তুমি অবৈধ' বলে ত্যাগ করেছেন।

-

আয়াত নাযিল হলো-

'তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদেরকে 'মায়ের মতো' বলে অবৈধ করে দাও, (কিন্তু) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা হতে পারে না। তাদের জন্মদাত্রীরা ছাড়া অন্য কেউ তাদের মা নয়। বস্তুত তারা যে কথা বলছে তা বিদ্বেষ্পূর্ণ ও অসত্য। নিশ্চয় আললাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।'(কুর'আন, ৫৮/২)

'আর যারা তাদের স্ত্রীদেরকে (মা্যের মতো বলে) অবৈধ করে দিয়েছে, তারপর নিজেদের উচ্চারিত কথা প্রত্যাহার করতে চায়, তবে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একজন দাসকে মুক্তি দাও; প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে এমনই তোমাদেরকে করতে হবে; আর তোমরা যা করো, আললাহ সবই অবগত।'(কুর'আন,৫৮/৩)

'তবে যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে টানা দু' মাস সিয়াম পালন করবে; আর যে এতেও অক্ষম হয় সে ষাট জন দরিদ্র মানুষকে আহার দান করাবে। ...'(কুর'আন,৫৮/৪)

‘আললাহ কোনো মানুষের/পুরুষের(লিরাজুলিন) মধ্যে তার জন্য দুটি হৃদয় স্থাপন করেন নি, আর তিনি তোমাদের স্ত্রীদেরকে তোমাদের মা করেনননি, যাদেরকে তোমরা অবৈধ ঘোষণা করছো, আর তিনি তোমাদের দাবীকে/আহবানকে/ইচ্ছাকে (দাল-আইন-ওয়াও> আদ’ইয়াইহিম) তোমাদের সন্তান করেননি; তা হলো তোমাদের মুখনিসৃত কথা, কিন্তু আললাহ সঠিক/সত্য বলেন এবং তিনিই পথ দেখান।’(কুর'আন,৩৩/৪)

-

(৩) ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় একসময় ঋণ পরিশোধ করতে না পারার অপরাধে মানুষকে দাসে পরিণত করা হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্রান্তিক সমাজে স্বাধীন মানুষের দাসত্ববরণের এটি ছিলো অন্যতম কারণ। কুর'আনের একটি আয়াত নাযিলের পর এই অন্যায় নিয়মটি বাতিল হয়ে যায়।

‘যদি ঋণগ্রহী দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তবে অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে সময় দাও, আর যদি দান (সাদাক্বা) হিসেবে মার্জনা করে দাও, তবে তা আরও উত্তম, যদি তোমরা তা উপলব্ধি করো।’(কুর'আন,২/২৮০)

Post a Comment

Previous Post Next Post