‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রভাব

‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রভাব



 কবি শামসুর রহমানের আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’ পড়তে গিয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। এই অবাক হওয়াটা ছিলো অনেকটা ‘Confirmation Bias’ থেকে। ছোটোবেলায় কবি তার বাড়িতে মাত্র ২-৩টি বই দেখেছিলেন। তারমধ্যে একটি ছিলো ‘বিষাদ সিন্ধু’। উপন্যাসটি তার এতো ভালো লাগে যে, তিনি সেটি একাধিকবার পড়েন।

তার নানী পড়ালেখা জানতেন না। কিন্তু, তিনি ‘বিষাদ সিন্ধু’র ভক্ত ছিলেন। কবি শামসুর রহমান নানীকে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে শুনাতেন। তার ধারণা ছিলো যে, তার নানী বিষাদ সিন্ধুকে ধর্ম-গ্রন্থ মনে করতেন। এই ধারণা একটা সময় পর্যন্ত কবির নিজেরও ছিলো। তখন বইটি হারিয়ে না গেলে তিনি আরো কয়েকবার বইটি পড়তেন বলে জানান।
আজ থেকে পনেরো বছর আগের কথাও যদি বলি, তাহলে বলতে হয় বাঙালি শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে যদি ২-৪ টি ‘আউটবই’ পাওয়া যেতো, তারমধ্যে অবশ্যই ‘বিষাদ সিন্ধু’ থাকতো। স্কুলে থাকাবস্থায় স্যাররা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “তুমি মুসলমান হয়েও ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়োনি?”
গতো ১৩০ বছরে বাংলাদেশের বহুল পাঠ্য কোনো উপন্যাস থেকে থাকলে সেটা ‘বিষাদ সিন্ধু’ হবে বলে আমার ধারণা। এই উপন্যাসের মতো আর কোনো মৌলিক উপন্যাস বাঙালি মুসলিম সম্ভবত পায়নি। বাঙালি মুসলমানের কাছে পাঠকপ্রিয়তার কথা বলতে গেলে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস হয়তো দ্বিতীয় হবে, তবে ‘বিষাদ সিন্ধু’র সাথে এর মার্জিন অনেক বেশি। ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের সাথে সবাই এতোটা পরিচিত না, যতোটা বিষাদ সিন্ধুর সাথে পরিচিত।
‘বিষাদ সিন্ধু’র আগে বাংলার মুসলিম সাহিত্য ছিলো অনেকটা পুঁথি সাহিত্য। আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা মিশ্রিত সেই পুঁথি সাহিত্য ছিলো বাঙালি মুসলমানের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। শীতকালে রাত জেগে পুঁথি পাঠ করা হতো, এখনকার সময়ে যেমন ওয়াজ মাহফিল হয়। মুসলমানদের পুঁথি সাহিত্য ছিলো ধর্মাশ্রিত। হুগলী, মুর্শিদাবাদ, কলকাতাসহ গ্রামাঞ্চলে পুঁথি পাঠের আসর বসতো।
সারারাত যে পুঁথি পাঠ করা হতো সেগুলো প্রকাশিত হতো কলকাতার কিছু সস্তা প্রকাশনী থেকে। তবে, বেশিরভাগ মুসলমানদের কাছে এই সাহিত্য জনপ্রিয়, নন্দিত হলেও বেশ কিছু সাহিত্য সমালোচকের কাছে পুঁথি সাহিত্য নিন্দিত ছিলো; তারা এর নাম দিয়েছেন ‘বটতলার সাহিত্য’ বা ‘বটতলার পুঁথি’।
পুঁথি সাহিত্যের দুজন সফল কবি ছিলেন- ফকির গরীবুল্লাহ এবং সৈয়দ হামজা। ফকির গরীবুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কাব্য তথা পুঁথিগুলো হলো: ইউসুফ জোলেখা, আমীর হামজা, সত্যপীরের পুঁথি, সোনাবান। অন্যদিকে সৈয়দ হামজার বিখ্যাত পুঁথি ছিলো: মধুমালতী, হাতেম তাঈ।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার নিয়ে রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে তিনি পুঁথি সাহিত্য বনাম বঙ্কিমের উপন্যাসের মার্কেট ডিমান্ডকে তুলনা করেন এভাবে:
“পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটা মূল্যবান বই লিখছিলেন। নামটা জানি কী। তিনি দেখাইছেন, যে সময়ে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলো প্রকাশ পাইবার লাগছিল, একই সময়ে বটতলার মুসলমানি পুঁথিগুলোও মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা অইয়া বাইর অইতে আছিল। বঙ্কিমের উপন্যাস দুইশ আড়াইশর বেশি ছাপা অইত না। কারণ আধুনিক সাহিত্য পড়ার পাঠক আছিল খুব সীমিত। কিন্তু বইটা পড়লে দেখতে পাইবেন মুসলমানি পুঁথি ছাপা অইতাছিল হাজারে হাজারে। বঙ্কিমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুঁথির বিষয়বস্তুর তুলনা করলে ডিফারেন্সটা সহজে বুঝতে পারবেন।”
পুঁথি সাহিত্যের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিলো ‘কারবালা’। বাঙালি মুসলমানের কাছে কারবালা ছিলো এক আবেগের বিষয়। রাতজেগে তারা কারবালায় হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) –এর শাহাদাতের ঘটনা শুনে দাড়ি ভেজাতো, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে মেয়েরা আঁচলে চুখ মুছতো।
কারবালার টপিকের চাহিদা এতো বেশি ছিলো যে, মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ লেখার পূর্বে কারবালা নিয়ে কমপক্ষে ১২ টি পুঁথি তখন ছিলো। তখনকার সময়ে একই টপিকে ডজনখানেক মানসম্মত পুঁথি থাকাটা সেই বিষয়ের গুরত্বের ইঙ্গিত করে। তাছাড়া, কারবালা নিয়ে শুধু মুসলমান পুঁথি সাহিত্যিকরা পুঁথি লিখেননি, লিখেছেন হিন্দু সাহিত্যিকরাও। রাধারমণ গোপ কারবালা নিয়ে লিখেন তার বিখ্যাত পুঁথি ‘ইমামের জঙ্গনামা’।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখছেন, তখন তার বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে আফসোস করে চিঠি লিখেছিলেন, “বাংলায় কি এমন কোনো মুসলিম নাই যিনি কারবালার কাহিনী নিয়ে মহাকাব্য লিখবেন? আমি যদি মুসলমান হতাম, আমার কাছে যদি সোর্স থাকতো তাহলে তো আমিই লিখতাম!”
তিনি মারা যান ১৮৭৩ সালে। তার মৃত্যুর ১২ বছর পর ১৮৮৫ সালে মীর মশাররফ হোসেন কারবালার ঘটনা নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ গদ্যকাব্য লিখেন। তিন খণ্ডের এই উপন্যাস লিখতে তার সময় লাগে ছয় বছর। ১৮৯১ সালে তিনি বিষাদ সিন্ধুর তিন খণ্ডে সমাপ্ত করেন। তিনি যে বিষাদ সিন্ধু লিখেন, সেটার সোর্স ছিলো মূলত পুঁথি সাহিত্য।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে কথ্য ভাষায় যেসব পুঁথি ছিলো, মীর মশাররফ সেগুলোকে উপন্যাসে রূপ দেন। তার স্বার্থকতার জায়গা ঠিক এখানে। পুঁথি সাহিত্য যেভাবে বাঙালি মুসলমানের বিনোদনের মূল খোরাক ছিলো, তেমনি সেই জায়গায় তখন স্থান পায় ‘বিষাদ সিন্ধু’। আগে পুঁথি পড়ে/শুনে মানুষ কাঁদতো, তখন কাঁদতে থাকে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে/শুনে।
মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ লেখার পূর্বে লিখেছিলেন ১২ টি বই। এই উপন্যাসটি ছিলো তার তেরোতম বই। সবমিলিয়ে তিনি লিখেন ৩৬ (মতান্তরে ৩৮) টি বই।
বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা, লেখার ভাষা কী সেটা নিয়ে তখন বেশ বিতর্ক হতো। মীর মশাররফ হোসেন এমন এক সময় উপন্যাসটি লিখেন, উপন্যাসে শব্দচয়ন, বাক্যরীতি, কাহিনী উপস্থাপনের ভঙ্গি দেখে অনেকেই চমকে উঠেন। বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তুমুল সাড়া ফেলে।
উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশের পর ‘ভারতী’ পত্রিকার ফাল্গুন ১২৯৩ বঙ্গাব্দে ‘রিভিউ’ দেয়া হয় এই বলে- “ইতিপূর্বে একজন মুসলমানের এত পরিপাটি বাঙলা রচনা দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।”
‘গ্রাম বার্তা প্রকাশিকা’ (১১ ই জ্যৈষ্ঠ ১২৯২) উপন্যাসটির ‘রিভিউ’ দেয় এভাবে- “মুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গ ভাষায় অল্পই অনুবাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।”
বাংলা ভাষায় একটি উপন্যাস ১৩০ বছর পরও তার আবেদন, প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখাটা বিস্ময়কর। যেকোনো ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস কতোটা ‘ঐতাহাসিক সত্য’ কতোটা ‘কল্পকাহিনী’ এই নিয়ে বিতর্ক হয়। ‘বিষাদ সিন্ধু’র বেলায়ও সেটার ব্যতিক্রম হয় না।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিয়া-প্রভাব ছিলো লক্ষণীয়। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাঠেও সেটা দৃষ্টিগোচর হয়। ড. আনিসুজ্জামান তার ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন, “সপ্তদশ শতাব্দীর পর ইরান থেকে অনেক শিয়া এসে বাংলায় আসন পাতেন। মুর্শিদাবাদের পরিপূর্ণ বিকাশের আগে হুগলি একটি শিয়া উপনিবেশ ও ফার্সি সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো।”
‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনাকাল, সোর্স তৎকালীন সমাজ বাস্থবতা উপেক্ষা করতে পারেনি। শিয়া সোর্সের প্রভাবে ‘বিষাদ সিন্ধু’ –তে যে আবেগ যোগ হয়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে, হবে। পড়ুয়া, সচেতন মুসলমান আস্তে আস্তে এই উপন্যাসকে ‘ধর্মগ্রন্থ’ মনে করে পড়া কমিয়ে দিচ্ছে। তারা এখন আর শামসুর রহমানের নানীর মতো বিষাদ সিন্ধুকে ধর্মগ্রন্থ মনে করছে না ঠিকই, কিন্তু স্রেফ উপন্যাস হিশেবে বিষাদ সিন্ধুর আবেদন হারিয়ে যাচ্ছে না।
কারবালা কেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম মানস গঠনে ‘বিষাদ সিন্ধু’ যে প্রভাব ফেলেছে, সেই জায়গায় ইতিহাসের আরেক ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে ইতিহাসবিদ, আলেম-উলামা, লেখকদের যে কাঠখড় পোড়াতে হবে, সেটা বলা বাহুল্য। বাঙালি মুসলমানের মনে ‘বিষাদ সিন্ধু’র বিপরীত কারবালার ন্যারেটিভকে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসাটা হবে একটি ঐতিহাসিক কাজ। দেখার বিষয় হলো, ১৩০ বছরের (+পুঁথি সাহিত্যের কাল) ন্যারেটিভ ভাঙ্গতে কতো বছর লাগে।
‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রভাব
লেখকঃ আরিফুল ইসলাম

Post a Comment

Previous Post Next Post