কাসেম সোলাইমানি কে? কেনই বা যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে এত বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল?

 

কাসেম সোলাইমানি কে? কেনই বা যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে এত বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল?



কাসেম সোলাইমানি কে? কেনই বা যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে এত বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল? 
এ মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত সমরবিদ কে? এ প্রশ্নের উত্তরে বহুমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এর সম্ভাব্য একটা উত্তর হতে পারে সিআইএ ও মোশাদের হিটলিস্ট। সারা বিশ্বে আলোচিত এক সামরিক চরিত্র ছিলেন ৬৩ বছর বয়সী ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তিনি ছিলেন দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাকে তার কাজের জন্য শুধু ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ আলি খামেনির কাছে জবাবদিহি করতে হতো।

২০১৩ সালে এক সাবেক সিআইএ অফিসার বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাধিক একক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি সোলাইমানি। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তার করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। তাকে সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত সমরবিদ মনে করা হচ্ছিল। তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো সামরিকজগতের বিশেষ নজরে ছিলেন। সিআইএ-মোশাদের হিটলিস্টে সোলাইমানি ছিলেন বলে বিভিন্ন খবরে জানা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলেসি’ জার্নাল ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা করে। এই তালিকার সামরিকখাতে জেনারেল সোলাইমানিকে 
প্রথম স্থানে রাখা হয়। মার্কিন প্রশাসন এই ইরানি জেনারেলকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল। তিনি মার্কিন সরকারের কালো তালিকায় ছিলেন। তিনি ইসরায়েল ও সউদী আরবেরও মাথাব্যথার কারণ ছিলেন।

‘হাজী কাসেম’ নামে পরিচিত এই জেনারেল তার ব্যতিক্রমী সমর-কৌশলের জন্য দ্রুত পরিচিতি পেয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে লেবানন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তার সামরিক কর্মকৌশল ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। তিনি বিভিন্ন ময়দানে সম্মুখসমরে যুদ্ধরত যোদ্ধাদের সাথে সরাসরি কথা বলতেন। কখনো তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে তাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় বাগদাদের বিমানবন্দরে ৩ জানুয়ারি হত্যা করা হয়েছে। তার হত্যার পর বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা গেল, নিকট অতীতে কোনো সামরিক কমান্ডারের মৃত্যুর পর এমনটি আর দেখেনি বিশ্ববাসী। শিয়া-সুন্নির বিভাজন দূরে ঠেলে তাই দেশে দেশে নির্যাতিতদের কাছে সোলাইমানি এক ‘প্রতিরোধ জনযোদ্ধা’য় পরিণত হয়েছেন। সাম্প্রতিক এক হিসাবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দুই কোটি ৭০ লাখ মুসলমান নিহত হয়েছেন। সেই তালিকায় সোলাইমানির নামও যুক্ত হলো।

প্রাথমিক জীবন

সোলায়মানির জন্ম ১৯৫৭ সালের ১১ মার্চ, কারমান প্রদেশের কানাত-ই মালেক গ্রামে।অতি সাধারণ, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে তিনি। পড়াশোনাও খুব বেশি নয়।পিতার ঋণ পরিশোধ করতে স্কুল শেষ করার পরে, তিনি কারমান শহরে চলে এসে একটি নির্মাণ সাইটে কাজ শুরু করেন । ১৯৭৫ সালে, তিনি কারমান ওয়াটার অর্গানাইজেশনের ঠিকাদার হিসাবে কাজ শুরু করেন । কাজ না থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় জিমে অনুশীলন করতেন । ধর্ম প্রচারক আলী খামেনিয়ের বক্তৃতায় অংশ নিয়ে 'বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে' উত্সাহিত হন।

১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর আইআরজিসি’তে যোগদান করেন। জেনারেল সোলাইমানির সামরিক প্রশিক্ষণের মেয়াদও ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। একজন প্রহরী হিসাবে কর্মজীবনের শুরুর দিকে, তিনি উত্তর-পশ্চিম ইরানে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের দমনে অংশ নিয়েছিলেন।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধে জেনারেল সোলাইমানি কেরমানের ৪১ ‘সারুল্লাহ’ ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন। ওই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি ইরানের প‚র্ব সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে। ওই অভিযানে তিনি মাদক চোরাকারবারী ও সন্ত্রাসীদের হত্যা করার মাধ্যমে ইরানের প‚র্ব সীমান্তের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটান।

১৯৯৭ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তাকে আইআরজিসি’র কুদস বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। ইরান রেভোলিউশনারি গার্ডসের এই অভিজাত বাহিনীটি দেশের বাইরে কভার্ট অপারেশন চালিয়ে থাকে। সে সময় ইরানের প‚র্ব সীমান্তে তালেবান যে হুমকি সৃষ্টি করেছিল তার অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি কাসেম সোলাইমানি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।

বিশাল এক আন্তর্দেশীয় ছদ্মযুদ্ধ
‘কুদস’ শব্দের অর্থ ‘
পবিত্র’। বোঝা যায়, সোলাইমানির এই বাহিনীর অগ্রযাত্রায় ধর্মীয় প্রণোদনা আছে। সেটা কতটা ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে, আর কতটা শিয়া মতাদর্শের পরিসর বাড়াতে, তা নিয়ে বিতর্কও আছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফ্রন্টে তৎপর দেখা যাচ্ছে ‘পবিত্র’ এই যোদ্ধাদের।

সোলাইমানি তাঁর বাহিনীর পুরো কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করেন শুধু আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে। তাই ইরানিরাও ‘কুদস্ ফোর্স’-এর সংখ্যা ও সামর্থ্য নিয়ে সামান্যই ওয়াকিবহাল । এই ‘ফোর্স’-এর সঙ্গে কাজ করছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিয়ুন’ আর ‘জাইনাবিয়ুন’ নামের মিলিশিয়া গ্রুপ এবং ইয়েমেনের হুতিরা । এর বাইরে সিরিয়া-ইরাকে শিয়াদের অনেক প্রশিক্ষিত বাহিনী রয়েছে ‘কুদস ফোর্স’-এর অধীনে। রীতিমতো আন্তমহাদেশীয় চরিত্রের যোদ্ধাদল এটি। সঠিক আকার ও সদস্যসংখ্যা আঁচ করা প্রকৃতই কঠিন। ইরান এদের বলছে ‘প্রতিরোধের অক্ষশক্তি’। অন্তত ১৫-২০টি দেশে সরাসরি কিংবা সীমিত পরিসরের ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের স্বার্থের বিপরীতে ছদ্মযুদ্ধে লিপ্ত এরা। সমরবিদ্যায় এ রকম যুদ্ধকে বলে ‘বড়যুদ্ধের মধ্যবর্তী ছোট ছোট অভিযান’। সৌদি আরব তার তেলক্ষেত্রে অজ্ঞাত উৎস থেকে পরিচালিত এ রকম এক অভিযান দেখেছে গত ১৪ সেপ্টেম্বর, যা বিশ্ব অর্থনীতিকেও খানিকটা ঝাঁকুনি দিয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের অন্তত ৫ ভাগ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র কেন দুশ্চিন্তায় ছিল?

ইরানিরা বছরের পর বছর প্রতি রাতে ঘুমাতে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার শঙ্কা নিয়ে।জানা যায়, সোলাইমানি নিছক একজন সেনা অফিসার ছিলেন না। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান কি ভ‚মিকা নেবে, তার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সোলাইমানি। বিবিসি জানাচ্ছে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভ‚মিকা তিনিই কার্যত পালন করতেন। বিশেষত যুদ্ধ কিংবা শান্তির ক্ষেত্রে তিনিই শেষ কথা। বলা হয়, সিরিয়ার যুদ্ধের কারিগরও নাকি তিনি। ইরাকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন মেজর জেনারেল সোলাইমানি।
ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘসময় ধরে শত্রুভাবাপন্ন হলেও ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আদর্শগত দিক বিবেচনায় পরোক্ষভাবে একে অপরকে সহায়তা করেছিল তারা। জেনারেল সোলাইমানি দুই বৈরি ভাবাপন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকাও পালন করেন। তার আগে আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন সেনাদেরকে প্রত্যাক্ষভাবে সহযোগিতা করেন তিনি। কিন্তু যেদিন ইরানের পরমাণু ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করেছে আমেরিকা, সেদিন থেকে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকতে শুরু করে।

হাজি কাসেম সরাসরি খামেনির কাছে দায়বদ্ধ, আর কারও কাছে নয়। ছবি: রয়টার্স

হাজি কাসেম ইরান সীমান্ত টেনে এনেছেন ইসরায়েলের পাশে

সোলাইমানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথাই বেশি। ইরানের এই জেনারেলকে তারা প্রকাশ্যেই ‘এক নম্বর শত্রু’ বলে। ইসরায়েল মনে করছে লেবানন, সিরিয়া, গাজা থেকে সোলাইমানির অদৃশ্য সৈনিকেরা ক্রমে তাদের ঘিরে ফেলছে। এভাবে ইরান সীমান্তকে সোলাইমানি টেনে নিয়ে এসেছেন ইসরায়েলের বাড়ির পাশে। অথচ তেহরান-জেরুজালেমের মাঝে দূরত্ব ১৫০০ কিলোমিটারের বেশি।

প্রতিবেশী সিরিয়ায় ইরানের কুদস ফোর্সের সামরিক দপ্তর থাকা ইসরায়েলের কাছে তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই অসহনীয় কিছু। ইসরায়েলের জেনারেলরা এটা কখনোই গোপন করেন না যে মোশাদের হিটলিস্টে সোলাইমানি সর্বাগ্রেই আছেন। ইরানেরও তা অজানা নেই। হয়তো এ কারণেই আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সোলাইমানিকে অভিহিত করেন ইরানের ‘জীবন্ত শহীদ’ হিসেবে।

কোনো কোনো ইসরায়েলি জেনারেল অবশ্য সোলাইমানির পরিবর্তে কেবল কুদস ফোর্সকে আক্রমণের পক্ষে। তাদের ভাষায়, ‘ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করলে মশা এমনিতেই মরে যায়। মশা মারা থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করা ভালো।’ তবে অনুমান করা হয়, ব্যক্তিগতভাবে সোলাইমানির ব্যাপারে কঠোর হতে ইসরায়েলের ওপর সৌদদের চাপ আছে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২০১৮ সালের নভেম্বরে এমন রিপোর্টও করেছে যে, সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার অন্তত এক বছর আগে একই খুনে দল ইসরায়েলের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে সোলাইমানিকে নিয়ে অনুরূপ কিছু পরিকল্পনা করছিল। এ কাজের বাজেট ছিল দুই বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য হাসিলে ভাড়াটে কোনো শক্তিকে ব্যবহারের কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে তা সফল হয়নি।

সামরিক কৃতিত্ব
এ বছরের মার্চে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি জেনারেল সোলাইমানিকে ‘
অর্ডার অব জুলফিকার’ পদক দিয়েছেন। বিপ্লব-উত্তর ইরানে এ খেতাব তিনিই প্রথম পেলেন। সরকারিভাবে এ অনুষ্ঠানের যে সংবাদ প্রচারিত হয়, তার ছবিতে দেখা যাচ্ছিল সোলাইমানির ঘাড়ে চুম্বন করছেন খামেনি। শিয়া সংস্কৃতিতে এ রকম ছবির প্রতীকী তাৎপর্য বিপুল।

ইরান, ইরানের বন্ধু এবং দেশটির শত্রু সবাই এটা এখন বিশ্বাস করে, মূলত সোলাইমানির কারণেই দেশটির সামরিক প্রভাবের পরিসর বাড়ছে। ইরাকে তাদের সামরিক উপস্থিতি বিপুল। ফলে তারা এখন সৌদি সীমান্তের কাছাকাছি আছে। সৌদদের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে ইরানের যে ছদ্মযুদ্ধ চলছে, তার প্রধান স্থপতি এই জেনারেল। আবার ইরাকে আইএস যে সাময়িকভাবে হলেও পরাস্ত, এককভাবে তার বড় কৃতিত্ব সোলাইমানিকেই দিতে হবে।

আসাদকে রক্ষার কৃতিত্বও তাঁর। বিরোধী দলের সঙ্গে আসাদের সংঘাতকে সোলাইমানি ইরান বনাম ইসরায়েল সংঘাতে পরিণত করে নিয়েছেন। কুদস ফোর্স মাঝেমধ্যেই উত্তর ইসরায়েলে মিসাইল ছুড়ে দেশটির বোমাবর্ষণের জবাব দিচ্ছে। তেল আবিব জানে, তাদের জন্য এ রকম বিরক্তি আরও বাড়বে।

সিরিয়া নিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়ার পাশাপাশি লেবাননে হিজবুল্লাহরও প্রধান অভিভাবক কাসেম সোলাইমানি। ইসরায়েলের পুনঃ পুনঃ বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ অতীতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী এখন। পুরোপুরি ইরানের হয়ে কাজ করছে তারা। এ ধরনের মৈত্রীকে শুধু শিয়াবাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে আমরা দেখব, সুন্নি তালেবানদের সঙ্গেও অতীতের শত্রুতার সম্পর্ক সম্পূর্ণ পাল্টে নিতে পেরেছেন সোলাইমানি। কুদস ফোর্সকে তালেবানদের অন্যতম মিত্র মনে করা হয় এখন, যা কূটনীতিবিদের কাছে গভীর এক বিস্ময় তৈরি করেছে ।

সোলাইমানির ‘অক্ষশক্তি’ যে ক্রমে সামরিক পরিসর ছেড়ে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, তারও বহু নজির আছে । হিজবুল্লাহ এক সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও এখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া লেবাননে সরকার গঠন আটকে যায়। ইরাকে ‘পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্স’ নামে পরিচিত সোলাইমানি প্রভাবিত মিলিশিয়াদের অনেক সংগঠক পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন এবং তাঁরা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এক ‘ব্লক’। ইয়েমেনে হুতিদের সশস্ত্র সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ’ সরাসরি একটা রাজনৈতিক শক্তিও বটে।

সোলাইমানির ধারাবাহিক সফলতার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর দিক হলো, এতে ছদ্মযুদ্ধের ন্যায্যতা তৈরি হচ্ছে এশিয়া-আফ্রিকার অন্যত্রও।

২০১৬ থেকে পরবর্তী দুই বছর বাদ দিলে ১৯৭৯ সাল থেকে গত প্রায় ৪০ বছর ইরানের অর্থনীতিকে অবরোধে ফেলে কাবু করার চেষ্টা চলেছে। সামরিক সক্ষমতা কমাতে ইরানের বহু বিজ্ঞানীকে চোরাগোপ্তা কায়দায় হত্যা করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। এর পাশাপাশি ‘মুজাহেদিন-ই খালক’, ‘জয়েস উল-আদিল’ নামের বিভিন্ন সংগঠন ইরানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত চালাতে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে দেশটির শত্রুদের কাছ থেকে। জেনারেল সোলাইমানি মনে করেন, এ রকম জটিল পরিস্থিতিতে ইরানকে তার অস্তিত্বের জন্যই সীমান্তের বাইরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উপস্থিতি বাড়াতে হবে। তিনি শত্রুর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে আচরণের পক্ষে ছিলেন।

হাজি কাসেমের মাঝে মালিক আল-আশতার (রা:) এর ছায়া

সামনাসামনি দেখলে এ ধরনের বিপজ্জনক চিন্তার মানুষটির যে বড় বৈশিষ্ট্যটি চমকে দেয় তা হলো, অতি সাদাসিধা জীবনযাপন। তারকা জেনারেলদের শরীরী ভাষায় যে ঔদ্ধত্য থাকে, কাসেম সোলাইমানি একদম তার বিপরীত। কেবল এ কারণেই, শিয়া মিথে ভরপুর ইরানের সমাজে অনেকে তাঁর মাঝে দেখেন হজরত আলীর (রা.) বিশ্বাসী সহযোদ্ধা মালিক আল-আশতারের ছায়া। সরাসরি রণাঙ্গনে ঘুরতে পছন্দ করেন এই জেনারেল। সামরিক পোশাকে নয়, সাধারণ একটা জ্যাকেট পরা অবস্থায় দেখা যেত অধিকাংশ সময় ।

খামেনি ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশা কম। ২০১৭ সালে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে অস্বীকার করেন। ইরানের অন্যান্য প্রধান নীতিনির্ধারকের মতো ধর্মীয় শিক্ষায়ও তিনি উচ্চশিক্ষিত নন।

ইতিহাসের মালিক আল-আশতার (রা:) বিষ প্রয়োগে নিহত হয়েছিলেন। সোলাইমানিকওে একই পরিনতি হলো ।

ইসরায়েলের সঙ্গে সিদ্ধান্তসূচক একটা সংঘর্ষে জড়ানোর আজন্ম গোপন অভিলাষ সোলাইমানির হয়তো অপূর্ণই থাকল। তবে ৬৩ বয়সী এই জেনারেল ইতিমধ্যে ইরানের জন্য তাঁর অবদান সম্পন্ন করে ফেলেছেন বলেই ধরা যায়। যেকোনো ‘দেশপ্রেমিক যোদ্ধা’র জন্য এটা তৃপ্তিকর

কাসেম সোলাইমানি (বাম) আবু মাহদী আল-মুহান্দিসের সাথে (ডান) তেহরানের মোসাল্লায় সোলেইমানির পিতার স্মরণসভায় (২০১৭) ।

মৃত্যু

২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি ক্ষেপণাস্ত্র তার কাফেলাটিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর পরে সোলেইমানি নিহত হন। তিনি সবেমাত্র তার বিমানটি ছেড়েছিলেন, যা ইরান থেকে লেবানন বা সিরিয়া পৌঁছেছিল। এছাড়াও পিএমএফ -এর নেতৃত্বদানকারী ইরাকি-ইরানি সামরিক কমান্ডার আবু মাহদী আল-মুহান্দিসহ আরও চার জন জনপ্রিয় চলাফেরার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন। ডিএনএর নিশ্চিতকরণ এখনও মুলতুবি থাকা অবস্থায় তার আঙুলের উপরে আংটি ব্যবহার করে তাঁর দেহ চিহ্নিত করা হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্ত প্রকাশ করা হয়।

সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইরান যেহেতু সমরাস্ত্রে এবং অর্থনীতিতে দুর্বল, তাই তেহরান কোনো অবস্থাতেই এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে মধ্যপ্রাচ্যে ছায়াযুদ্ধের আরো বিস্তৃতি ঘটাবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে ইয়েমেনে হুতিদের দিয়ে সৌদি আরবে হামলার মাত্রা বাড়াতে পারে। ইসরাইলি অবস্থানে মিত্রদের দিয়ে হামলা করাতে হয়তো কসুর করবে না। এদিকে ইরাকে নিজেদের সমর্থিত সরকার থাকা সত্ত্বেও দেশটির পার্লামেন্টে মার্কিন সৈন্য না রাখার বিল পাস করা হয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের প্রভাববলয় সঙ্কুচিত হতে পারে। ইরান তাই যুদ্ধ ঘোষণা না করেও আঞ্চলিক গেরিলা প্রতিরোধে সফল হতে পারে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফের ভাষায়, প্রতিরোধের বৃক্ষ আরো শাখা ছড়াবে।

তথ্যসূএ

Qasem Soleimani - Wikipedia

Was the US killing of Qasem Soleimani legal?

কাসেম সোলাইমানি: দুনিয়ার এক নম্বর জেনারেল!

কে ছিলেন সোলাইমানি

Post a Comment

Previous Post Next Post