হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণের বিধান কী?

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণের বিধান কী?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণের বিধান কী?

 হিন্দু ধর্মগ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণের বিধান কী? জন্দ্রনাথ পাহাড়ে বিফ বারবিকিউ নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টিকে উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের পায়তারা করা হচ্ছে। এসবের পেছনে রয়েছে হয়ত ষড়যন্ত্রের হাত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জানার চেষ্টা করব, হিন্দুধর্মগ্রন্থে  আসলে গো-মাংস ভক্ষণের বিধান কী?

"গরু গোশ্ত খাওয়া হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে বৈধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের বিশেষভাবে

জ্ঞান থাকা জরুরি। সনাতন শাস্ত্র সামবেদের একটি উদ্ধৃতি  হচ্ছে- সামবেদে মুহাম্মদের (সা.) এর পরিচয় বর্ণনা করে বলা হয়েছে - যার নামের প্রথম অক্ষর 'ম' এবং শেষ অক্ষর 'দ' হবে এবং গো মাংস খাওয়ার আদেশ দিবেন, সেই দেবতাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় দেবতা । বলা হয়েছে, "মদৌ বর্তিতা দেবা দকারান্তেপ্রকৃত্তিতা, বৃষানাং ভক্ষায়েত্‍ সদা মেদাশাস্ত্রেচস্মৃতা"। অর্থাৎ "যে দেবের নামের প্রথম অক্ষর"ম" ও শেষ অক্ষর "দ" এবং যিনি বৃষমাংস (গরুর মাংস) ভক্ষণ সর্বকালের জন্য পুনঃ বৈধ করিবেন, তিনিই হইবেন বেদানুযায়ী ঋষি।"

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "এই ভারতবর্ষেই এমন এক দিন ছিলো যখন কোন ব্রাহ্মণ গরুর মাংস না খেলে ব্রাহ্মণই থাকতে পারতেন না। যখন কোন সন্ন্যাসী, রাজা, কিংবা বড়ো মানুষ বাড়িতে আসতেন, তখন সবচেয়ে ভালো ষাঁড়টিকে কাটা হতো। (Collected works of Swami Vivekananda, Advaita Asharama,1963, Vol III, page 172)।

ঋকবেদের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে সায়ন আচার্যের নাম বিখ্যাত। তাঁর আগেও বিভিন্ন ভাষ্যকার, যেমন স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, প্রমুখ ঋকবেদের ভাষ্য করেছেন।

ভাষ্যকার আচার্য সায়ন লিখেছেন তার অনুবাদে, "You (O Indra), eat the cattle offered as oblations belonging to the worshippers who cook them for you. (Atharvaveda 9/4/1)".

"হে ইন্দ্র গ্রহন কর সেসব গরুর মাংস যা তোমাকে তোমার ভক্তরা রন্ধন করে উৎসর্গ করেছে।"

ঋকবেদ ১০/৮৬/১৩ তে গোরু রান্না করার কথা পাওয়া যায়। ঋকবেদ ১০/৮৬/১৪ তে ইন্দ্রের জন্য গোবৎস উৎসর্গ করা হয়েছে।

Rig Veda 10.86.১৪ [Indra speaks The worshippers dress for me fifteen (and) twenty bulls : I eat them and (become) fat, they fill both sides of my belly ;Indra is above all (the world).

উপনিষদেও গোরু খাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

ভালো সন্তান পাবার জন্য ষাঁড়ের মাংস খাওয়া উচিত।

Brihadaranyak Upanishad 6/4/18 suggests a ‘super-scientific’ way of giving birth to a super intelligent child.

এ ব্যাপারে আরো স্পষ্ট বিধান দিয়েছে মনুসংহিতা। মনুসংহিতা ৫/৪৪ বলা হয়েছে, "শ্রুতিবিহিত যে পশুহত্যা, তাহাকে অহিংসাই বলিতে হইবে, যেহেতু বেদ ইহা বলিতেছে।"

অগ্নির কাছে নিবেদনে বলদ, ষাঁড় এবং দুগ্ধহীনা গাভী বলিদানের উল্লেখ আছে। (ঋকবেদ সংহিতা, ১/১৬২/১১-১৩, ৬/১৭/১১,১০/৯১/১৪)।

মহাভারতেও গোরু খাওয়ার কথা আছে, মহাভারত বন পর্ব, খন্ড ২০৭, অনুবাদে কিশোরী মোহন গাংগুলি।

বিষ্ণুপুরাণ বলছে,ব্রাহ্মণদের গো-মাংস খাইয়ে হবিষ্য করালে পিতৃগণ ১১ মাস পর্যন্ত তৃপ্ত থাকেন। আর এ স্থায়িত্ব কালই সবচেয়ে দীর্ঘ (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬)। বৃষের মাংস [বেদ:১/১৬৪/৪৩],মহিষের মাংস [বেদ: ৫/২৯/৮],অজের মাংস [বেদ:১/১৬২/৩] খাওয়া হতো। আরও বলা হয়েছে পরস্বিনী গাভী মানুষের ভজনীয় [বেদ:৪/১/৬]।

 আর এজন্যই হয়তোবা স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,

"You will be astonished ifI tell you that, according to the old ceremonials, he is not a good Hindu who does not eat beef. On certain occasions he must sacrifice a bull and eat it. [The complete works of Swami Vivekananda, Volume 3, Pg 536]"

জগত গুরু আদি শংকরাচার্য,যিনি ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। তিনি অদ্বৈত বেদান্ত শাখার প্রতিষ্ঠাতা। শংকরাচার্যের গীতাভাষ্য হিন্দু ধর্মীয় পন্ডিত মহলে অত্যন্ত বিখ্যাত। তিনি ব্রাহ্মসূত্র অধ্যায় ৩, পাদ্য ১, সূত্র ২৫ এ লিখেছেন, "যজ্ঞে পশু হত্যা পাপ হিসেবে বিবেচিত হবে না, কারন শাস্ত্রই ইহার অনুমোদন দিয়েছে।”

মহাত্মা গান্ধী বলেছেন,

"I know there are scholars who tell us that cow-sacrifice is mentioned in the Vedas. I… read a sentence in our Sanskrit text-book to the effect that Brahmins of old (period) used to eat beef. ( M.K.Gandhi, Hindu Dharma, New Delhi, 1991, p. 120).

অর্থাৎ, "আমি জানি (কিছু সংখ্যক পণ্ডিত আমাদের বলেছেন) বেদে গো-উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ আছে। আমি আমাদের সংস্কৃত বইয়ে এরূপ বাক্য পড়েছি যে,পূর্বে ব্রাহ্মণরা গো-মাংস ভক্ষণ করতেন।" (হিন্দুধর্ম,এম.কে. গান্ধী,নিউ দিল্লি,১৯৯১,পৃ. ১২০)॥

অতএব এবার নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় গোরু খাওয়া হিন্দু ধর্ম সম্মত।

তবুও  হিন্দু ধর্মে গোরুকে 'পবিত্র মাতা' বলা হয়ে থাকে। গোরু নানাভাবে মানুষের উপকার করে বলে হিন্দু ধর্মে গো-হত্যা নিষিদ্ধ। তবে গোরুর চামড়া দিয়ে জুতো তৈরী করে তা ব্যবহার করা কিন্তু হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ নয়।

অবশ্য বৌদ্ধ যুগের আগ পর্যন্ত হিন্দুরা প্রচুর গোমাংস ভক্ষণ করতেন এ তথ্যও অনেকেই জানেন। ব্যাসঋষী স্বয়ং বলেছেন, 'রন্তিদেবীর যজ্ঞে একদিন পাচক ব্রাহ্মণগণ চিৎকার করে ভোজনকারীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন,মহাশয়গণ! অদ্য অধিক মাংস ভক্ষণ করবেন না, কারণ অদ্য অতি অল্পই গো-হত্যা করা হয়েছে; কেবলমাত্র একুশ হাজার গো-হত্যা করা হয়েছে। (সাহিত্য সংহিতা-৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৭৬)

বৌদ্ধযুগের পূর্ব পর্যন্ত হিন্দুরা যে প্রচুর গোরু গোশত খেতেন ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রণীত Beef in Ancient India গ্রন্থে, স্বামী ভুমানন্দ প্রণীত 'সোহংগীত', 'সোহং সংহিতা, 'সোহং স্বামী' গ্রন্থগুলোতে, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের 'জাতি গঠনে বাধা' গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এসব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৌদ্ধযুগের আগে পর্যন্ত গো-হত্যা, গো-ভক্ষণ মোটেই নিষিদ্ধ ছিলো না। মধু ও গো-মাংস না খাওয়ালে তখন অতিথি আপ্যায়নই অপূর্ণ থেকে যেতো।

অনেকেরই ধারণা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গোমাংস খায় না বা খেত না । এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ।

বৌদ্ধ সম্রাট অশোকের সময় থেকে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ২০০০ বছর আগে হলেও গো-হত্যা আরও অনেক পরে নিষিদ্ধ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্রাট অশোকের নিষেধাজ্ঞা হিন্দুরা মানছে কেন?

এটাও ধর্মীয় সংঘাতের ফল । বৌদ্ধ ধর্ম এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, প্রচুর লোক, বিশেষ করে তথাকথিত “ নীচ জাতি” আকৃষ্ট হয়েছিল, এই ধর্মের প্রতি ।

ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং ব্রাহ্মণরা প্রমাদ গুনলো । তারাও পুরোপুরি মাছ- মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলো।

মূলত, এটা উত্তরভারতেই হয়েছিলো।

বেশি দিনের কথা নয়, আলিবর্দির সময়ে রামপ্রসাদের গুরু কৃষ্ণা নন্দ আগম বাগীশ একটা বই লিখেন। নাম – "বৃহৎ তন্ত্রসার"। এতেও অষ্টবিধ মহামাংসের মধ্যে গোমাংস প্রথম বলেই বলা হয়েছে ।

ঋকবেদে প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ সূক্তের ৪৩ নং শ্লোকে বৃষ মাংসের খাওয়ার কথা আছে । মহিষ মাংসের উল্লেখ আছে পঞ্চম মণ্ডলের ২৯ নং সূক্তের ৮ নং শ্লোকে ।

মোষ বলি আজও হয় । নেপালে যারা মোষের মাংস খায়, তাদের ছেত্রী বলা হয় ।

এছাড়া, বনবাস কালে রামচন্দ্রের লাঞ্চের মেনু কি ছিল, অনেকেরই জানা নেই । তিন রকম মদ ( আসব ) গৌড়ী, ( গুড় থেকে তৈরি ) পৌষ্টি, ( পিঠে পচিয়ে তৈরি ) মাধ্বী ( মধু থেকে তৈরি ) । এর সঙ্গে প্রিয় ছিল- শূলপক্ব গোবৎসের মাংস । বিশ্বাস না হলে রামায়ণ পড়া উচিত । রামকে যদি কল্প চরিত্র বলেও ধরি, তাহলেও এই গুলো তখনকার খাদ্যাভ্যাসের নমুনা ।

হিন্দুদের গোরুর গোস্ত খাওয়া বেদের কোথাও নিষিদ্ধ নেই; বরং খাওয়ার বিধান আছে-

“-বৃষের মাংস [বেদ:১/১৬৪/৪৩], মহিষের মাংস [বেদ: ৫/২৯/৮], অজের মাংস [বেদ:১/১৬২/৩] খাওয়া হত।আরও বলা হয়েছে পরস্বিনী গাভী মানুষের ভজনীয় [বেদ:৪/১/৬]। গো-হত্যা স্থানে গাভীগণ হত্যা হত [বেদ:১০/৮৯/১৪]। ইন্দ্রের জন্য গোবৎস উৎসর্গ করা হয়েছে। [ঋকবেদ: ১০: ৮৬: ১৪]। এমনকি উপনিষদ বলছে:‘বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে, স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরি।” [সূত্র: বেদ; ২য় প্রকাশ, পৃ: ১৩, ৬৭; হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা।

সুতরাং হিন্দুধর্ম শাস্ত্র মতে গো-মাংস ভক্ষণে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।"

-জি. মোস্তফা

Post a Comment

Previous Post Next Post