দাজ্জাল তথা অ্যান্টিক্রাইস্ট

দাজ্জাল তথা অ্যান্টিক্রাইস্ট

 দাজ্জাল তথা অ্যান্টিক্রাইস্ট

দাজ্জাল তথা অ্যান্টিক্রাইস্ট - শেখ ইয়াসির ক্বাদি/ করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর থেকেই আবার নতুন করে অনেকে এই প্রশ্নটা করছে - এটা কি দাজ্জালের কাজ? দাজ্জাল জিনিসটাই বা কী? আসলেই কি দাজ্জাল নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে? কোথায় আছে এই দাজ্জাল? অথবা কবে আবির্ভাব ঘটবে দাজ্জালের?


বলে রাখি, এসব বিষয়ে আমার এমন গভীর জ্ঞান নেই যে, আমি নিজেই মৌলিক কোনো লেখা লিখব। কাজেই আমি আমি যে লেখাটা লিখছি, সেটা মূলত শেখ ডঃ ইয়াসির ক্বাদির একাধিক লেকচার থেকে নেওয়া তথ্যের ভাবানুবাদ। উপস্থাপনের সুবিধার জন্য আমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছি, সিরিয়াল আগেপরে করেছি, কিন্তু তথ্য এবং উদাহরণগুলো সব ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকেই নেওয়া।

ইয়াসির ক্বাদির লেকচারই কেন? কারণটা সহজ, আমার কাছে এ ধরনের টপিকে ইয়াসির ক্বাদির ব্যাখ্যাগুলোকেই যুগোপযোগী এবং বাস্তবসম্মত মনে হয়।

হাদিস নিয়ে স্পেশালাইজেশন থাকার কারণে বিভিন্ন হাদিসকে পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে কীভাবে বুঝতে হবে, তার কোন অংশকে সরাসরি গ্রহণ করতে হবে, কোন অংশকে কতটুকু রূপক অর্থে গ্রহণ করা যাবে, এবং তারচেয়েও বড় কথা, অন্যান্য স্কলাররা হাদিসটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, এসব ব্যাপারে ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়।

এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

দাজ্জাল কে বা কী?

দাজ্জাল হচ্ছে একটা অশুভ সত্ত্বা, যার আগমন ঘটবে শেষ জমানায়, পৃথিবী ধ্বংসের কাছাকাছি সময়ে। ইসলাম ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, শেষ জমানায় ভালো এবং মন্দের মধ্যে যে চূড়ান্ত লড়াই হবে, তাতে একদিকে ঈমানদারদের নেতৃত্বে থাকবেন পুনরায় আবির্ভূত হওয়া মাসীহ ঈসা, আর তার বিপরীতে অবিশ্বাসীদের নেতৃত্বে থাকবে মাসিহ আদ-দাজ্জাল।

এই চূড়ান্ত ভালোর সাথে চূড়ান্ত খারাপের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের ধারণা শুধু ইসলামেই ইউনিক না, খ্রিস্টধর্মেও আছে। খ্রিস্টানদের, বিশেষ করে ইভ্যাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই লড়াইটা হবে জেসাস ক্রাইস্ট তথা ট্রু মেসায়াহ এবং অ্যান্টি ক্রাইস্ট তথা ফলস মেসায়াহ'র মধ্যে। এই অ্যান্টি ক্রাইস্ট বা ফলস মেসায়াহ-ই হচ্ছে দাজ্জাল।

ইহুদীদের ধর্মে অবশ্য ঠিক সেভাবে দাজ্জালের কথা নাই। কিন্তু এই না থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ - ধর্মীয় দিক থেকে তো বটেই, রাজনৈতিক দিক থেকেও। এবং ইসলাম র্মবিশ্বাস অনুযায়ী দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারীই যে হবে ইহুদীরা, সেটারও প্রধান একটা কারণ হচ্ছে তাদের ধর্মগ্রন্থে দাজ্জালের উল্লেখ না থাকাটা। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলাপ করা হবে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, দাজ্জালের আবির্ভাবের ব্যাপারটা কতটুকু সত্য? দাজ্জালের কথা কি কুরআনে আছে, যে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতেই হবে? নাকি এটা শুধু অল্প কিছু দুর্বল হাদিসে বা অন্যান্য উপকথায় আছে, যা সেরকম জোরালোভাবে বিশ্বাস না করলেও চলবে? উত্তরটা সহজ। দাজ্জালের কথা কুরআনে নেই, কিন্তু এতো বেশি সহিহ হাদিসে এটার বর্ণনা আছে যে, এটাতে বিশ্বাস অপরিহার্য্য।

দাজ্জালের বর্ণনা প্রায় সব হাদিসের বইয়ে আছে। সিহাহ সিত্তা হিসেবে পরিচিত ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থের বাইরেও মুসনাদ ইমাম আহমাদ, তাবারানিসহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে দাজ্জালের উপর প্রচুর হাদিস আছ, যেগুলো সহিহ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রায় ৪০ জন সাহাবি দাজ্জাল বিষয়ক বিভিন্ন হাদিস বর্ণনা করেছেন।

কোনো বিষয়ে যখন বিপুল সংখ্যক সহিহ‌ হাদিস পাওয়া যায়, তখন তাকে বলা হয় 'মুতাওয়াতের' তথা সর্বোচ্চ পর্যায়ের হাদিস, যা অনেকে বর্ণনা করেছেন। যখন একজন-দুইজন কোনো একটা ঘটনা বর্ণনা করেন, তখন হয়তো সেটা নিয়ে সন্দেহ করা যেতে পারে। কিন্তু যখন অনেক বেশি সংখ্যক সাহাবি সেটা বর্ণনা করেন, তখন তার সত্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। দাজ্জালের বিষয়টা হচ্ছে সেই পর্যায়ের।

এখন কথা হচ্ছে, দাজ্জাল আসলে কী? দাজ্জাল কি কোনো ব্যক্তির নাম, নাকি এটা রূপক জাতীয় কিছু? এমন কি হতে পারে, দাজ্জাল বলতে আসলে উপমা হিসেবে কোনো সিস্টেমকে বোঝানো হয়েছে? যেমন টেলিভিশন, অথবা ডলার, অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, অথবা বিভিন্ন গোপন সংগঠন?

যদিও কিছু কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তা সঠিক না বলেই মনে হয়। কারণ একাধিক সহিহ হাদিসে দাজ্জালের দৈহিক বর্ণনা এতো বিস্তারিতভাবে এসেছে, যা কেবলমাত্র মানুষের সাথেই মানায়। তবে দাজ্জাল নামক সেই মানুষের থাকবে কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা, যার ফলে সে সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে।

কীভাবে বিভ্রান্ত করবে? সে প্রথমে নিজেকেই নবী হিসেবে, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মেসায়াহ তথা মাসিহ হিসেবে দাবি করবে। যেহেতু শেষ জমানায় মাসিহ ঈসা (আ)-এরও আসার কথা আছে এবং যেহেতু দাজ্জাল কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে, তাই অনেকে তার এই দাবি বিশ্বাস করে, তার বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতায় বিভ্রান্ত হয়ে তার ফাঁদে পা দিবে। নিজের দল ভারি করার পর একটা পর্যায়ে গিয়ে সে নিজেকে স্বয়ং খোদা হিসেবেও দাবি করবে।

দাজ্জাল শব্দটার অর্থ কী? 'দাজ্জাল' কিন্তু দাজ্জালের প্রকৃত নাম না। তার প্রকৃত নাম হবে অন্য কিছু, দাজ্জাল হবে তার উপাধি বা পরিচয়। দাজ্জাল শব্দটা এসেছে আরবি "দাজালা" থেকে। দাজালা অর্থ মিশ্রণ ঘটানো বা প্রতারণা করা। কিন্তু সাধারণ কোনো প্রতারণা না, ভয়ঙ্কর ধরনের প্রতারণা।

দাজ্জাল যেহেতু সর্বনিকৃষ্ট মিথ্যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যের সাথে মিশিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করবে, নিজেকে প্রথমে ঈসা এবং পরবর্তীতে খোদা দাবি করবে, তাই তার এই উপাধি হবে।

প্রধান দাজ্জাল তথা মাসিহ আদ-দাজ্জাল হবে একজনই, যার আবির্ভাব ঘটবে শেষ জমানায়। কিন্তু এর আগে বিভিন্ন সময় অনেকগুলো ছোট ছোট দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, অথবা বলা যায় ঘটে গেছে।

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত সহিহ হাদিসে আছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামাত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না প্রায় ত্রিশজন মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আগমন ঘটবে। আগমনের পর তারা প্রত্যেকেই দাবী করবে যে, তারা আল্লাহর রাসূল। (সহিহ মুসলিম)

অর্থাৎ এই হাদিস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে দাবি করবে, তাকেই দাজ্জাল বলা যাবে। এবং কেয়ামতের পূর্বে এরকম অন্তত প্রায় ৩০জন দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তবে এর মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হবে সর্বশেষ দাজ্জাল, যাকে নিয়ে এই আলোচনা।

দাজ্জালকে মাসিহ আদ-দাজ্জাল বা ফলস মেসায়াহ বলা হয় কেন? মাসিহ বা মেসায়াহ মানে কী? মাসিহ শব্দটা এসেছে মাসাহা থেকে, যার অর্থ মুছে দেওয়া, ঘষা বা পরিষ্কার করা। আগেকার দিনে বনী ইসরায়েল বংশে যখন নতুন কোনো নবী আসত, তখন পূর্ববর্তী নবী জর্ডান নদীর নিয়ে পানি দিয়ে তার কপাল মুছে দিত। খ্রিস্টানদের মধ্যে ব্যাপটিজমের যে ধারণা প্রচলিত, শিশুকে পবিত্র পানি দিয়ে মুছে দেওয়া, সেটাও এখান থেকেই এসেছে।

হযরত ঈসা (আ)-এর ক্ষেত্রে এটা করেছিলেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট তথা হযরত ইয়াহইয়া (আ)। ঈসা (আ) হচ্ছেন সর্বশেষ নবী, যাকে আল্লাহর নির্দেশে মাসাহা করানো হয়েছিল। সেজন্যই তিনি মাসিহ ঈসা। কিন্তু তাহলে দাজ্জালকে কেন মাসিহ বলা হয়?

ধারণা করা যায়, সম্ভবত দাজ্জালকেও মাসাহা করানো হবে। যেহেতু সে নিজেকে নবী দাবি করবে, তাই সম্ভবত তার অনুসারী ইহুদীরা তাকে সত্যিকার ঈসা মনে করে তাকে মাসাহা করবে। আর সে জন্যই সে মাসিহ আদ-দাজ্জাল বা ফলস মেসায়াহ।

দাজ্জাল কখন আসবে? এর উত্তরে এক কথায় বলা যায় শেষ জমানায়। কিন্তু এই শেষ জমানা কবে? সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব না। কারো পক্ষে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব না যে, অমুক সালে দাজ্জাল আসবে। কারণ রাসুল (স) নিজেও এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো দিনক্ষণ বলে যাননি। তবে তিনি দাজ্জালের আগমনের অনেকগুলো পূর্বশর্ত বলে গেছেন, যেগুলো সাধারণভাবে কেয়ামতের আলামত নামেই পরিচিত।

দাজ্জাল হচ্ছে কেয়ামতের ১০টি বড় আলামতের একটি। কেয়ামতের অনেকগুলো ছোট ছোট আলামত আছে, যার অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়ে হয়েছে, অল্প কিছু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এ ধরনের ছোট আলামতের মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে মাহদির আগমন।

আর বড় আলামতগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে দাজ্জালের আগমন। মাহদির আগমনের কিছু কাল পরেই দাজ্জালের আগমন ঘটবে, এবং তারও কিছু কাল পরে ঈসা (আ)-এর আগমন ঘটবে। অন্তত কিছুটা সময় তারা তিনজন একইসাথে পৃথিবীতে অবস্থান করবে।

সুতরাং বলা যায়, ইমাম মাহদি না আসা পর্যন্ত দাজ্জাল আসবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইমাম মাহদি কখন আসবেন? এ ব্যাপারেও হাদিসে পরিষ্কার কোনো দিনক্ষণ দেওয়া নেই। কিন্তু বিভিন্ন সহিহ হাদিস থেকে যা জানা যায়, ইমাম মাহদির আবির্ভাব এমন সময়ে ঘটবে, যখন মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থাকবে।

কোনো এক খলিফার বা রাজার বা নেতার মৃত্যুর পর তিনজন খলিফাপুত্রের বা তিনজন প্রিন্সের বা তিনজন ক্ষমতার উত্তরাধিকারীর মধ্যে কোনো গুপ্তধনের বা পুরস্কারের বা ক্ষমতার উত্তরাধিকারের জন্য প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকবে, কিন্তা তারা কেউই জয়ী হবে না।

এমন সময় মদিনায় রাসুলের বংশ থেকে মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ নামের এক পুণ্যবান ব্যক্তির বা নেতার আবির্ভাব ঘটবে। সম্ভবত ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারবে যে, এই লোক তাদের জন্য হুমকি এবং তারা তাকে হত্যা করতে চাইবে। ফলে প্রাণভয়ে মদিনা থেকে পালিয়ে মক্কায় এসে আশ্রয় নিবেন।

কিন্তু সেখানে মানুষ তাকে মাহদি হিসেবে চিনে ফেলবে এবং তাকে ঘর থেকে বের করে এনে হাজরে আসওয়াদ এবং মাকামে ইব্রাহীমের মাঝামাঝি স্থানে তাকে নেতা বানিয়ে তার হাতে বাইআত দিবে। একই সময় খোরাসান থেকে একদল কালো পতাকাবাহী যোদ্ধা মক্কার দিকে এগিয়ে আসবে এবং মাহদির সাথে যোগ দিবে। এবং তখনই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে, মাহদির আগমন ঘটেছে।

মাহদির আগমনের পর মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হবে, কিন্তু তখন তাদের যুদ্ধ শুরু হবে কাফেরদের সাথে। এ পর্যায়ে অনেকগুলো সিরিজ যুদ্ধ সংঘটিত হবে, যা মালহামা তথা মহাযুদ্ধ নামে পরিচিতি পাবে।

এখানে বলে রাখা ভালো, ইমাম মাহদি, দাজ্জাল, বা মালহামা সংক্রান্ত হাদিসগুলোর অধিকাংশই খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটবে তা পরিষ্কার করে বলা নেই। ফলে এই মহাযুদ্ধ কী একটাই যুদ্ধ নাকি অনেকগুলো ছোট ছোট যুদ্ধের সমষ্টি, কিংবা কোন যুদ্ধের পর কোন যুদ্ধ, সেগুলোও পরিষ্কার করে বোঝার উপায় নেই।

ফলে স্কলারদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত আছে। একটা হচ্ছে, মালহামা তথা মহাযুদ্ধ একটাই - সেটা হচ্ছে ঈসা (আ) এর সাথে দাজ্জালের যুদ্ধ, কিন্তু এর আগে অনেকগুলো ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হবে।

আর অন্য একটা মত হচ্ছে, মালহামা আসলে শেষ জমানার অনেকগুলো যুদ্ধের সমষ্টি। হতে পারে পুরো ওয়ারটা একত্রে মালহামা, কিন্তু তার অধীনে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অনেকগুলো ব্যাটেল সংঘটিত হবে। এবং এই সবগুলো ব্যাটেল মিলেই হবে মালহামা তথা মহাযুদ্ধ।

সুতরাং ইমাম মাহদি আসার আগে মুসলমানদের মধ্যেই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলতে থাকবে। কিন্তু মাহদি মাসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার পর শুরু হবে মুসলমানদের সাথে কাফেরদের সিরিজ যুদ্ধ। এই পর্যায়ে দুই ধরনের যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়।

প্রথমে মুসলমানদের একটা দল কাফেরদের একটা দলের সাথে মিলে কমন একটা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, কিন্তু তাদেরকে পরাজিত করার পর মুসলমানদের সাথে কাফেরদের দলটার যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

এই যুদ্ধগুলো হবে এমন ভয়াবহ, যা মানুষ অতীতে কখনও দেখেনি। যেমন মুসলিম শরিফে ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে, যেখানে বিলাদ আশ্‌শাম তথা লেভান্টে রোমানদের বিরুদ্ধে টানা চারদিন যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে বলে উল্লেখ আছে।

প্রথম তিনদিন দিনভর যুদ্ধের পর মুসলমানদের সবাই শহিদ হয়ে যাবে। কেউই জীবিত ফিরে আসবে না। অবশেষে চতুর্থ দিনের দিন তারা বিজয় লাভ করবে। উল্লেখ্য, এখানে রোমান বলতে ইতালিয়ানদেরকে না বুঝিয়ে গড়ে খ্রিস্টানদেরকে বা পশ্চিমা শক্তিকে বোঝানো হতে পারে।

এই হাদিসে আরো বলা হয়েছে এই যুদ্ধ এতো ভয়াবহ হবে যে, যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে যেসব পাখিরা উড়ে যাবে, তারাও মৃত্যুমুখে পতিত হবে। প্রতি ১০০ সদস্যের গোত্রের মধ্যে ৯৯ জনই এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করবে।

সুতরাং এসব বর্ণনা থেকে ধারণা করা যেতে পারে, এটা গতানুগতিক কোনো যুদ্ধ হবে না। হতে পারে এই যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা, রাসায়ানিক গ্যাস বা অন্য কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহৃত হবে।

এই যুদ্ধের শেষে কেউ একজন এসে অবশিষ্ট জীবিত যোদ্ধাদেরকে দুঃসংবাদ দিবে, তাদের পরিবাররা যে শহরে আছে, সেখানে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে যোদ্ধারা দলবেঁধে সেখানে ছুটে যাবে। কিন্তু গিয়ে দেখবে ওটা ছিল মিথ্যা গুজব, দাজ্জাল তখনও আসেনি। কিন্তু এর কিছুদিন পরে আসলেই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে।

সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়ারা থেকে বর্ণিত অন্য একটা হাদিসে আছে, মুসলমানদের সাথে রোমানদের আ'মাক অথবা দাবিক নামক স্থানে ভয়াবহ একটা যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে থাকবে মদিনা থেকে আসা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা এবং সেই সাথে খ্রিস্টধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত বিপুল সংখ্যক মুসলমান যোদ্ধা।

ঐ যুদ্ধে এক তৃতীয়াংশ মুসলমান পালিয়ে যাবে, এবং তারা হবে ক্ষমার অযোগ্য। অন্য এক তৃতীয়াংশ শহীদ হবে, তারা হবে শহীদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এবং শেষ এক তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে, যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। এবং এই বিজয়ী এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা এরপর কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তাম্বুল জয় করবে।

এখন যেহেতু ইস্তাম্বুল বর্তমানে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে, তাই ধারণা করা যেতে পারে, শেষ জমানার আগে ইস্তাম্বুল হয়তো আবারও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। হাদিসের পরবর্তী অংশে বলা হয়, ইস্তাম্বুল জয় করার পর এই বাহিনী যখন বিজিত সম্পদ ভাগাভাগিতে ব্যস্ত থাকবে, তখন তাদের কাছে সংবাদ আসবে যে, দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটেছে।

কিন্তু তারা ছুটে গিয়ে জানতে পারবে, ওটা আসলে মিথ্যা সংবাদ ছিল। এরপর তারা বিলাদ আশ্‌শামের দিকে যাত্রা করবে। ততদিনে আসলেই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, কিছু যুদ্ধ হবে, এবং এরপর ঈসা (আ)-এর আবির্ভাব ঘটবে।

সুতরাং এই আলোচনা থেকে মোটামুটি যা বোঝা যায় তা হলো, ইমাম মাহদী না আসা পর্যন্ত, এবং এরপর তার বাহিনীর সাথে রোমানদের ভয়াবহ কিছু যুদ্ধ (যেসব যুদ্ধে খুব সম্ভবত নিউক্লিয়ার বা কেমিক্যাল উইপন ব্যবহৃত হবে) সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে না।

এখন কথা হচ্ছে, দাজ্জাল যে আবির্ভূত হবে, মানুষ তাকে চিনবে কীভাবে? অনেকগুলো সহিহ হাদিসে দাজ্জালের দৈহিক বিবরণ দেওয়া আছে। যেমন দাজ্জালের অন্তত একটা চোখ নষ্ট থাকবে। তার পায়েও সমস্যা থাকবে, সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে।

তার কপালের মধ্যে "কাফের" শব্দটা বানান করে লেখা থাকবে। তবে নিরক্ষর ঈমানদার ব্যক্তিরাও এই লেখা পড়তে পারবে। সুতরাং এটা হয়তো এমন একটা বৈশিষ্ট্য হবে, যা কেবল ঈমানদার ব্যক্তিদেরই চোখে পড়বে।

দাজ্জালের কোনো সন্তান থাকবে না। তার চেহারা হবে ককেশীয়দের মতো। তার চুল হবে কোঁকড়া। সে হবে তুলনামূলকভাবে খাটো এবং প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী।

দাজ্জাল আসবে পূর্বদিকের খোরাসান (বৃহত্তর ইরানের উত্তরাঞ্চল) নামক এলাকা থেকে। তাকে যারা অনুসরণ করবে, তারা হবে এমন চেহারার, যাদের চেহারা হবে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সমান করা বর্মের মতো। অর্থাৎ তাদের চেহারা হবে সমতল। সুতরাং দাজ্জালের অনুসরারীরা আরব হবে না। তারা হবে অন্য এলাকার মানুষ।

অন্য একটা হাদিসে আছে, দাজ্জাল আসবে ইসফাহান (ইরানের একটা প্রদেশ) থেকে। ইসফাহানের একটা ইহুদী গোত্র থেকে তার আবির্ভাব হবে। সেখানকার ৭০,০০০ ইহুদী তার অনুসারী হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, সম্রাট নেবুচাদনেজারের সময় ইহুদীদের প্রথম টেম্পল ধ্বংসের সময় থেকেই ইহুদীদের একটা দল ইসফাহানে গিয়ে বসতি গড়েছিল এবং আজও তাদের উত্তরাধিকারীরা সেখানে বসবাস করছে। সেখানে আজও তাদের একটা সিনেগগ আছে।

অন্য একটা হাদিসে আছে, সে আসবে ইরাক এবং শামের মাঝামাঝি এলাকায়। স্কলাররা এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে প্রথমে ইসফাহানে, কিন্তু এরপর সে কুখ্যাতি অর্জন করবে ইরাক এবং শামে গিয়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতো স্পষ্টভাবে দাজ্জালের বর্ণনা থাকার পরেও কেন মানুষ তার ফাঁদে পা দিবে? কেন অনেকে তাকে মেসায়াহ বলে বিশ্বাস করবে? এর কারণটাও বোঝা যায় হাদিস থেকেই।

সহিহ হাদিসে আছে, দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এমন এক সময়, যখন পৃথিবীতে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা, রক্তপাত, অনাহার এবং দুর্ভিক্ষ বিরাজ করবে। এবং উপরের আলোচনা অনুযায়ী, দাজ্জালের আবির্ভাবের পূর্বে ভয়াবহ কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হবে, যেগুলো হবে গণবিধ্বংসী।

এরকম একটা সময়ে দাজ্জাল এসে তার অনুসারীদেরকে নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা দিবে। তার কিছু অতি-মানবীয় ক্ষমতাও থাকবে। শয়তান অথবা খারাপ জ্বীন তার অধীনস্থ থাকবে। তাদেরকে দিয়ে সে আপাত কিছু অসাধ্য সাধন করতে পারবে।

সে বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারবে। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে বিনা হিসাবে খাদ্য বিলাবে। ফলে মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা তাদের সন্তানদেরকে বাঁচানোর জন্য সহজেই তার ধোঁকায় পড়বে।

দাজ্জাল মৃত ব্যক্তিদেরকে জীবিত করার ভান করবে। তার অধীনস্থ জ্বীনরা মৃত ব্যক্তির চেহারা ধরে আবির্ভূত হবে এবং মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দেরকে বলবে যে, দাজ্জালই হচ্ছে আসলে সত্যিকার মেসায়াহ।

অন্তত একবার সে সত্যি সত্যিই মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করে দেখাবে। এবং এই ক্ষমতার কারণে সে নিজেকে ঈসা হিসেবে দাবি করবে। এবং এই কারণেও অনেকে ধোঁকায় পড়বে।

হাদিসে আছে, রাসুল (স) বলেছেন, দাজ্জালের হাতে থাকবে জান্নাহ এবং নার, অর্থাৎ স্বর্গ এবং নরক, কিন্তু তার জান্নাহ হবে আসলে নার, আর নার হবে আসলে জান্নাহ।

কেউ কেউ এটাকে আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু অনেকে বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে তার হাতে থাকবে প্রাচুর্য এবং শাস্তি বা নির্যাতন। কিন্তু প্রচুর্যের ফাঁদে পা দিলে ধ্বংস নিশ্চিত, আর তার শাস্তি বা নির্যাতন মেনে নিলেই পরকালে মুক্তি নিশ্চিত।

আবির্ভাবের পর দাজ্জাল কী করবে? সে প্রতিটা শহরে যাবে। প্রতিটা বলতে অবশ্য আক্ষরিক অর্থে দুনিয়ার সবগুলো শহরে নাও হতে পারে। আরবিতে 'কুল্লি' শব্দটা অধিকাংশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সে দুনিয়ার অধিকাংশ শহরে যাবে।

কিন্তু সে মক্কা এবং মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। ফেরেশতারা তাকে বাধা দিবে। মদীনায় প্রবেশ করতে না পেরে সে তিনবার ভূমিকম্প ঘটাবে। ভূমিকম্পের ভয়ে মুনাফেকরা ভয়ে পালিয়ে যাবে, রয়ে যাবে কেবল খাঁটি ঈমানদাররা।

মদিনায় ঢুকতে না পেরে দাজ্জাল মদিনার সীমানার বাইরে গিয়ে একটা পাহাড়ের উপর উঠবে। অনেকে মনে করে এটা হচ্ছে মদিনার বাইরে যেসব পাহাড়ের উপর রাজকীয় প্রাসাদগুলো অবস্থিত, সেগুলোর মধ্যে একটা হতে পারে।

পাহাড়ের উপর উঠে দাজ্জাল তার অনুসারিদেরকে মদিনার দিকে নির্দেশ করে বলবে, তোমরা কি ঐ বাইত আল-আবিয়াদ (সাদা বাড়ি) দেখতে পাচ্ছ? ওটা হচ্ছে আহমাদের বাড়ি এবং মসজিদ।

উল্লেখ্য, বাস্তবেই মসজিদে নববি কমপ্লেক্সটা সাদা রংয়ের মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। এবং প্লেন থেকেও পুরো মদিনা শহরের মধ্যে এই সাদা কমপ্লেক্স পৃথকভাবে চোখে পড়ে।

মক্কা-মদিনায় প্রবেশ করতে না পারলেও বিভিন্ন শহরে গিয়ে দাজ্জাল প্রচুর অনুসারী জোগাড় করে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করবে। তার সেনাবাহিনীর সাথে মুসলমানদের অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হবে।

এগুলোর মধ্যে কয়েকটাতে হয়তো মুসলমানরা জয়লাভ করতে পারবে, কিন্তু তারা দাজ্জালের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তার মৃত্যু হবে কেবলমাত্র ঈসা (আ) এর হাতে।

হাদিসে আছে, দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০ দিন থাকবে। কিন্তু এই ৪০ দিনের ১ দিন এক বছরের মতো, ১ দিন এক মাসের মতো, ১ দিন এক সপ্তাহের মতো এবং এরপরের দিনগুলো হবে সাধারণ দিনের মতো।

এই হাদিসের ব্যাখ্যা কী? যদি আসলেই পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হয়, তাহলে এটা মোটেও অসম্ভব না যে, প্রথম এক বছর পর্যন্ত সূর্য এমনভাবে ঢাকা পড়ে থাকবে যে, সেই এক বছরকে এক রাতের মতো মনে হবে। এরপর ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হতে থাকবে। ফলে দ্বিতীয় রাতটা হবে এক মাস, এরপর এক সপ্তাহ, এরপর দুনিয়া স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

কিন্তু এই ৪০ দিনের বা এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী ১ বছর ৩ মাসের মানে এই না যে, দাজ্জালের আয়ুই হবে মাত্র এতটুকু। হতে পারে এর আগে সে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠবে, কিন্তু এই সময়টুকুতেই সে দাজ্জাল হিসেবে সক্রিয় থাকবে।

হাদিস অনুযায়ী, সে সাধারণ শিশুর মতোই বেড়ে উঠবে, কিন্তু এরপর কেউ কোনো কারণে তাকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার পর সে নিজের পাওয়ার বুঝতে পারবে, এবং দাজ্জাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

এবার আসা যাক সর্বশেষ প্রসঙ্গে। হাদিসে আছে, দাজ্জালের অনুসারীদের অধিাকংশই হবে ইহুদী। কেন? কারণটা খুবই ইন্টারেস্টিং।

তার আগে বলে রাখা ভালো, দাজ্জালের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনেকটা মুসলমানদের মতোই। বিশেষ করে ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানদের।

ইভেঞ্জেলিক্যালরা বিশ্বাস করে, যীশু বা ঈসাই হচ্ছেন মাসিহ বা মেসায়াহ, এবং শেষ জমানায় তিনি আবার দুনিয়াতে আসবেন। এবং সে সময় একজন ফলস মেসায়াহ বা অ্যান্টি ক্রাইস্টের আবির্ভাব ঘটবে। এবং এই ট্রু ক্রাইস্ট এবং অ্যান্টি ক্রাইস্টের মধ্যে আর্মাগেডন বা মহাযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে।

অর্থাৎ মোটের উপর তাদের বিশ্বাস আমাদের মতোই। কিন্তু তারা আরেকটা বাড়তি জিনিস বিশ্বাস করে এবং সেটা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম প্রধান একটা কারণ। ইভ্যাঞ্জেলিক্যালরা বিশ্বাস করে, যীশুর আগমন কেবল তখনই ঘটবে, যখন বনী ইসরায়েলের বংশধররা পবিত্র ভূমিতে গিয়ে একত্রিত হবে।

আর ঠিক এ কারণেই তারা মনেপ্রাণে চায়, দুনিয়ার সব ইহুদীরা ইসরায়েলে গিয়ে বসতি স্থাপন করুক, যেন তাদের বিবলাক্যাল ভবিষদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়, এবং তাদের জীবদ্দশাতেই যীশু পুনরায় পৃথিবীতে আসে, অ্যান্টিক্রাইস্টকে পরাজিত করে, এবং তাদেরকে নিয়ে স্বর্গে চলে যায়!

এবং এ কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে হার্ডলাইন জায়নিস্টদের অনেকেই ইহুদী না, বরং ইভেঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান! উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার কথা বলা যায়। আমেরিকার ইহুদীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই জায়নিস্ট না। কিন্তু আমেরিকার ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানরা ইসরায়েলের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক।

কিন্তু ইভেঞ্জেলিক্যালদের এই ব্যাপারটা পুরাই আয়রনিক। কারণ তারা ইহুদীদেরকে ইসরায়েলে পাঠাতে চায় তাদের কল্যাণের জন্য না, বরং ধ্বংসের জন্য! তারা চায় দুনিয়ার ইহুদীরা সব ইসরায়েলে গিয়ে জড়ো হোক, যেন যীশু পৃথিবীতে এসে সেই ইহুদীদেরকেই ধ্বংস করতে পারে!

কথা হচ্ছে, ইহুদীরা কি তাদের এই ষড়যন্ত্র বোঝে না? উত্তরটা হচ্ছে, বোঝে ঠিকই। কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না। কারণ ইহুদীদের অধিকাংশই মাহদির আগমনে বা যীশুর পুনরাগমনে কিংবা দাজ্জালের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। ইভ্যাঞ্জেলিক্যালরা তাদেরকে ইসরয়েলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে, তাতেই তারা খুশি।

ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাসেও অবশ্য শেষ জামানায় একজন মাশিয়াখ বা মাসিয়াহ বা মেসায়াহ আসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের মতে এই মাসিহ কোনো ধর্মীয় নেতা হবেন না, তিনি হবেন "মালাখ" মাশিয়াখ, তথা কিং মাসিহ।

অর্থাৎ তিনি হবেন একজন ভবিষ্যত রাজা, দাউদ (আ) এর একজন উত্তরসূরী। তিনি সুদিন বয়ে আনবেন, ইহুদিদেরকে কিংডম অফ ডেভিড ফিরিয়ে দিবেন, তাদের টেম্পল পুনর্নিমান করে দিবেন।

এ কারণেই ইহুদীরা মেসায়াহ'র ধর্মসংস্কার নিয়ে আগ্রহী না, তারা আগ্রহী একজন রাজার আবির্ভাবের। এবং এ কারণেই ঈসা (আ) যেহেতু রাজা ছিলেন না, নিছক ধর্মপ্রচারক ছিলেন, তাই তারা তার ধর্ম গ্রহণ না করে উল্টো রোমান সম্রাটের কাছে গিয়ে তার নামে বিচার দিয়েছিল।

বর্তমানকালের ইহুদীদের মধ্যে শুধুমাত্র অর্থোডক্সরাই মেসায়াহর আগমনে বিশ্বাস করে। এবং সেটা তারা বেশ গভীরভাবেই করে। মধ্যযুগে ইহুদীদের প্রধান ধর্মগুরু বা চীফ র‌্যাবাই ছিলেন একজন আরব, মুসা ইবনে মাইমুন। তিনিই সর্বপ্রথম জুইশ কোড লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

তিনি মোট ১৩টি পয়েন্টে ইহুদীদের মূল ধর্মবিশ্বাসকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। এই পয়েন্টগুলোর মধ্যে ১২ নম্বর পয়েন্টটা হচ্ছে, "আমি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করি মাসিহ-এর আগমনে। যত দেরিই হোক, আমি প্রতিদিন তার আগমনের জন্য অপেক্ষা করি।"

এবং এটাই আজও অর্থোডক্স ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাস। তারা আজও অপেক্ষায় আছে যেকেনো মুহূর্তে হয়তো মাসিহ-এর আগমন ঘটবে। এই অর্থোডক্সদের মধ্যে একটা গ্রুপ আছে, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মাসিহ-এর আসার সময় হয়ে গেছে। এবং তারা একাধিকবার একাধিক র‌্যাবাইকে মাসিহ বলে বিশ্বাসও করে ফেলেছিল।

কাজেই সত্যি সত্যিই যখন দাজ্জাল আসবে, এবং ইসফাহানের ইহুদীদের বা বনী ইসরায়েলের বংশধরদের একটা গোত্রের মধ্য থেকেই আসবে, তখন এটা মোটেও আশ্চর্যজনক না যে, তার অনুসারীদের অধিাকংশই হবে সেই অর্থোডক্স ইহুদীরা, যারা এরকম একজনের অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল।

এবং যেহেতু ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাসে দাজ্জাল বা ফলস মেসায়াহ'র কোনো অস্তিত্ব নাই, তাই তারা কোনো চিন্তাভাবনা না করেই সেই ফলস মেসায়াকেই ট্রু মেসায়া বলে বিশ্বাস করে তার দলে যোগ দিবে।

--- লেখাটা ইয়াসির ক্বাদির Understanding The Traditions of The Signs of Judgement Day সিরিজের কয়েকটা ভিডিও লেকচারের সামারি। ভিডিওগুলোতে আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন ইবনে সাইয়াদ, তামিম দ্বারী এবং দন মেহ।

আলোচনা সংক্ষিপ্ত এবং ফোকাসড রাখার জন্য সেগুলো উল্লেখ করিনি। আগ্রহীরা ইউটিউব থেকে সিরিজটা শুনে দেখতে পারেন।

ছবিটিঃ প্রতিকী
-মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা 

Post a Comment

Previous Post Next Post