কেন আমাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়? মানবজাতির উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা'আলা তার কালামুল্লাহ্ শরীফে বলেছেন,❝আমি মানুষকে দূর্বল করে সৃষ্টি করেছি❞।
ধরিত্রী-ধরণীর মাঝে আল্লাহ্ তাআলা মনিষ্যিসমাজকে দূর্বল-কমজোর বানিয়ে পাঠালেও, দেয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। যে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে আসীন করিয়েছেন আমাদের। দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ মর্যাদা-সম্মান ও অগণিত নাজ-নেয়ামত। যার শুকরিয়া আদায়ে আমরা সক্ষম নই। আল্লাহ্ তাআলা তআলার অশেষ নেয়ামতের মধ্যে আমাদের বিশেষ যে নেয়ামতটি দান করেছেন। শেষ নবী জনাবে মুস্তফা, খাতামুল আম্বীয়া হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য।
আরো দিয়েছেন—যেকোনো কাজ নিজ ইচ্ছেতে করার ক্ষমতা। দিয়েছেন ইচ্ছেশক্তি। ঘ্রাণশক্তি। ভালো-মন্দ সৎ-অসৎ, হালাল হারাম এমন সব বিষয় বিবেচনা করার যথেষ্ট ক্ষমতা-সক্ষমতা।
ভালো-মন্দ সৎ-অসৎ, ঠিক-বেঠিক, হালাল-হারাম চেনার জন্য, জানার জন্য। সঠিকটা যাচাইয়ের জন্য দিয়েছেন পবিত্র কোরআন। এই পবিত্র কুরআনে আমাদের জীবন চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপের কথা খুব নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। বর্ণনা করে দিয়েছে—মা'য়ের পেট হতে কবর পর্যন্ত মধ্যবর্তী যে সময়টুকু তুমি সপ্তাদ্বীপায় অবস্থান করবে তার পথনির্দেশনা। আর এই নির্দেশনাগুলো মনে রাখার জন্য, হৃদয়ে গেঁথে রাখার জন্য, মনে প্রোথিত করার জন্য, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করার জন্য দিয়েছেন স্মৃতিশক্তি, মেধা বা ব্রেইন।
আমাদের যখন পাঁচবছর বয়স ছিলো তখন কী করেছিলাম সেটা আমাদের মেধা আমাদের জানিয়ে দেয়। দশ বছর পূর্বে কোন কাজটি কোথায় কীভাবে করেছিলাম তা জানিয়ে দেয়। গত পাঁচদিন পূর্বে কী করেছিলাম কোথায় করেছিলাম তাও জানিয়ে দেয়। এক মিনিট পূর্বে কী করছিলাম তাও জানিয়ে দেয়। এইযে মনে থাকার একটা সিস্টেম এটা কিন্তু আমাদের স্মৃতি, মেধা বা ব্রেইন কন্ট্রোল করে থাকে। আমাদের মেধা মনে করিয়ে দেয় 'তোর' এখন এটা করা প্রয়োজন, ওটা করা প্রয়োজন অতঃপর আমরা করি।
একবার ভাবুন তো! যদি আমরা দশ বছর আগে কী হয়েছে তা বলতে না পারতাম। পাঁচবছর আগে কী হয়েছে যদি মনে করতে না পারতাম। পাঁচদিন আগে কী হয়েছে যদি মনে করতে না পারতাম বা এক সেকেন্ড আগে কী কাজটা করছিলাম সেটা যদি মনে রাখতে না পারতাম তাহলে আমাদের জীবনটা কেমন হতো!একবার ভাবুন কেমন হতো! হয়তোবা বেঁচে থাকার লিপ্সটা হারিয়ে ফেলতাম।
আল্লাহ্ ভালোবেসে আমাদের যে স্মৃতিশক্তি দান করেছেন, সময়ের সাথে সাথে, নিজ কর্মফলের কারণে এদিক সেদিক হয়। আপনি মাঝে মাঝে খেয়াল করবেন দেখবেন— দশদিন আগে কী করেছেন মনে নেই, বা দেরিতে মনে হচ্ছে। পাঁচদিন আগে কী করেছেন মনে নেই, বা দেরিতে মনে হচ্ছে আপনি এক মিনিট আগে কী করছিলেন সেটাও ভুলে যান। আবার আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ এমন আছে যারা কি-না পাঁচদিন আগে কী করেছে তা আদৌ মনে করতে পারে না।
এটার আসল রহস্য কি জানেন! এটার আসল রহস্য হলো আমাদের কর্মফল। আল্লাহ্ যখন এই ধরিত্রী মাঝে কোনো মনুজকে পাঠান তখন তার জীবন চলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ স্মৃতিশক্তি দিয়ে পাঠান। আর সেই পর্যাপ্ত স্মৃতিশক্তিটাই আমাদের কর্মের কারণে আস্তে আস্তে একটা সময় লোপ পেতে থাকে। কমতে থাকে। ডেমেজ হতে থাকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে। এটা হওয়ার একমাত্র ও অনন্য কারণ হলো গোনাহ্।
এখন প্রশ্ন হলো! আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের যে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্মৃতিশক্তি দিয়েছেন তা-কি আমরা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছি? নাকি অসচেতনতার কারণে তা হারিয়ে ফেলছি? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে খোয়ে ফেলছি? খারাপ কাজে ব্যয় করে ফেলেছি?
চলুন প্রথমে জেনে নেই স্মৃতি কাকে বলে?
মস্তিষ্কে ধারণকৃত তথ্যকে স্মৃতি বলে। এই প্রক্রিয়ার প্রথমে তথ্য আহরিত হয়, মস্তিষ্কের মধ্যে জমা হয় তারপর যেখানে যেখানে প্রয়োজন হয় সেখানে সেখানে সেই তথ্য বের করে কাজে লাগানো যায়। যদি কারো জমাকৃত তথ্য সঠিক সময়ে খুঁজে পাওয়া না যায় তাঁর স্মৃতিশক্তি কম।
পূর্বের জমাকৃত ঘটনাগুলো যে যত বেশি স্মরণ রাখতে পারবে তার স্মৃতি শক্তি ততবেশি। বয়সের ভার বেশি হলে মাথার মস্তিষ্ক কম কাজ করে। মাথার মধ্যে আছে নিউরন। কোন কারণে এই নিউরন আক্রান্ত হলে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। মস্তিষ্কের মধ্যে এই নিউরনের কাজ হলো শরীর এবং মনের যা কিছু ঘটছে তার হিসাব রাখা। তাই নিউরনের কোন সমস্যা হলে স্মৃতি শক্তির উপর তার অনেকটা প্রভাব পড়ে।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার কারণ কী?
বিভিন্ন কারণে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে যায়। স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়াকে বিস্মৃতি বলা হয়। আর বিস্মৃতি হচ্ছে শিক্ষা ও স্মৃতি-এর বিয়োগফল। মনোবিজ্ঞানী ক্রিডার বলেন, ❝কোন নির্দিষ্ট তথ্য স্মরণ করার অক্ষমতাকে বিস্মৃত বলে❞। স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে, তবে কিছু কারণ মাথায় গেঁথে রাখা আবশ্যক। নিম্নরূপ-
* গোনাহের কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। যখন একজন মানুষ অতিরিক্ত গুনাহের কাজে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গোনাহের সাগরে তলিয়ে যায় তখন তাঁর অন্তরাত্মা মরে যায়, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায় আর আস্তে আস্তে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে।
* হস্তমৈথুন; বর্তমান সময়ে যুবক-যুবতীরা এই ঘৃণ্য কাজে নিজেকে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে নিয়েছে, ধ্বংস করে দিচ্ছে নিজেদের জীবন-যৌবন। বরবাদ করে দিচ্ছে নিজেদের আমল। অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের ফলে যেমন যৌবন ফুরিয়ে যায় তেমনি স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে।
* পঠিত বিষয়ে পর্যালোচনার অভাবে- মানুষ যখন কোন কিছু পাঠ করে বা দেখে তখনই তা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। কিন্তু সেই পঠিত বিষয় আবার পুনরায় পাঠ না করলে সেটা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে থাকে, ফলে বিস্মৃতি ঘটে।
* মনোযোগের অভাবে- প্রত্যেকেরই উচিত যখন কোন কিছু করবে, দেখবে বা পড়বে তা মনোযোগ সহকারে দেখা, করা বা পাঠ করা। অন্যথায় মানুষ তা ভুলে যেতে পারে। আর মনোযোগহীনতা মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেয়।
* প্রকারগত পরিবর্তনের কারণে- মানুষের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ধরনের প্রকারগত পরিবর্তনের কারণেও স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
* শারীরিক অসুস্থতার কারণে- মানুষের বিভিন্ন বড় ধরনের শারীরিক অসুস্থতার জন্যেও অনেক সময় স্মৃতিশক্তি কমে যায়। এটা হরহামেশাই চোখে পড়ে।
* সৃজনশীলতার অভাবে- সৃজনশীলতা বা কোন কিছু উদ্ভাবনের ক্ষমতা মানুষকে অনেক বেশি চিন্তা করতে ও পাঠ করতে বাধ্য করে, যা মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেয়। আর এর অভাবে স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
* নিয়মিত অধ্যয়ন না করলে- নিয়মিত অধ্যনয় করলে মানুষের ব্রেন অনেক বেশি সচল ও উর্বর হয়ে উঠে। আর নিয়মিত অধ্যয়ন না করলে মানুষের মস্তিস্ক তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে স্মৃতিশক্তিও কমে যায়।
* অবদমন- নিজস্ব ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতিগুলো মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই আসে। মানুষ যখন এই ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতিগুলো রোধ করে রাখে, তখন মস্তিষ্কও তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে দেখা দেয় বিস্মৃতি।
* মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে- মানুষের স্মৃতি তার মস্তিষ্ক অর্থাৎ ব্রেনে থাকে। আর এটা অত্যন্ত নাজুক একটি স্থান। অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা থেকে মস্তিষ্কে আঘাত লেগে স্মৃতিশক্তি কমে যেতে বা স্মৃতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
* পুষ্টিকর খাবারের অভাবে- খাবার মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। খাবার ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আবার খাবার শুধু খেলেই হবে না। তাতে থাকতে হবে সঠিক পুষ্টিগুণ। কারণ সঠিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারের অভাবে কমে যেতে পারে স্মৃতিশক্তি। তাই সুস্থ সবল জীবন চান সুষম খাবার রোজই খান।
* অতিসম্প্রতি যুক্তরাজ্য মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন এবং হেলথ রিসার্চ প্রোগ্রামের উদ্যোগে ছয় বছর ব্যাপী এক সমীক্ষায় উপসংহারে বলা হয়, মোবাইল ফোন ব্যবহারে ব্রেনের স্বল্পকালীন সমস্যা হয় না। কিন্তু গবেষকগণ স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া সহ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে বলে ধারনা করছেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা আমরা সকলেই মেনে চলার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত যেনো অযথা অমূলক পণ্ড না হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন।