ইতিহাসের আলোকে ক্ষমতা তত্ত্ব রাজনীতির ক্ষমতার প্রশ্নে ফতোয়ার কিতাবাদী একপাশে সরিয়ে রাখাই ভালো। কেননা, রাজনীতির ক্ষমতা অর্জন বা ক্ষমতা দখল ফতোয়া নির্ভর নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার গতিপথ নির্ধারণ করেন রাজনীতিবিদরা, মুফতি সাহেবগণ নন।
'গণতন্ত্র হারাম, কুফরি নাকি জায়েজ?' এই প্রশ্নটি আমার কাছে বিলাসী আলাপ মনে হয়। এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা-অযৌক্তিকতার আলাপ বৈঠক আর পুস্তকেই সীমাবদ্ধ, রাজনীতির ময়দানে এমন প্রশ্নের গুরুত্ব ঐতিহাসকিভাবে শূন্যের পর্যায়।
এই ফতোয়া দেখে রাজনীতিতে যোগদান কিংবা এই ফতোয়া দেখে রাজনীতি বিমুখতার অর্থ হলো- সেই ব্যক্তি রাজনীতির ইতিহাস পড়েনি। যে রাজনীতির ইতিহাস পড়বে, সে ক্ষমতা অর্জন বা ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে ফতোয়ার তালাশ করবে না।
এবার দেখি, রাজনীতির ইতিহাস আমাদের কী বলে।
প্রথম তিনজন খলিফার পর পরবর্তী খলিফা হবার যোগ্য ক্যান্ডিডেট ছিলেন আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। এমনকি, তৃতীয় খলিফা নির্বাচনে আলী (রা:) ছিলেন উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। উসমান (রা:) -এর ইন্তেকালের পর সাহাবীদের মধ্যে যেমন অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন আলী (রা:), তেমনি তাঁর যোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত। মদীনার সাহাবীরা তাঁর হাতেই আনুগত্যের শপথ করেন, তাঁকে খলিফা হিশেবে মেনে নেন।
সিরিয়া থেকে আলীর (রা:) খিলাফতের বিরোধিতা করেন মুআবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। সেই পরিস্থিতিতে তাঁর রাজনৈতিক আচরণ ছিলো 'বিদ্রোহী'। রাজনীতির প্রশ্নে আপনি যদি সাদা-কালো তত্ত্বে বিশ্বাসী হোন, তাহলে আপনাকে এই দুজন থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। আপনি যদি আলীকে (রা:) বলেন আইনানুগ খলিফা, তাহলে মুআবিয়াকে (রা:) বলতে হবে 'বিদ্রোহী'। কারণ, একই সময়ে তো দুজন খলিফা থাকতে পারেন না।
খারেজীদের হাতে আলী (রা:) শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাহাদাতবরণের পর খলিফা হোন তাঁর ছেলে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাতি হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। তখনো কিন্তু দুজন খলিফা। কুফায় হাসান (রা:), দামেস্কে মুআবিয়া (রা:)।
এই অবস্থায় হাসান (রা:) রাজনৈতিক ঝামেলায় আর জড়াতে চাইলেন না। তিনি খিলাফতের দাবি থেকে পদত্যাগ (Resign) ঘোষণা করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, আলী ও হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) -এর খিলাফতের দাবি যদি যৌক্তিক দাবি হয়ে থাকে, তারা দুজন খলিফা হবার জন্য যোগ্য ক্যান্ডিডেট হয়ে থাকলে মুআবিয়ার (রা:) দাবি কি অযৌক্তিক কিংবা অবৈধ কি-না? দুই সাহাবীর রাজনৈতিক দাবির প্রশ্নে আপনার অবস্থান কোন সাহাবীর পক্ষে?
একজন ইতিহাস বিশ্লেষককে এই জটিল প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার কাছে এই প্রশ্নে এখন পর্যন্ত এই উত্তরটি সর্বোত্তম মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, "খিলাফতের দাবি প্রত্যাহার করে হাসান (রা:) মানুষের কাছে নৈতিকভাবে জিতে যান। আর খিলাফতের আসনে অটল থেকে মুআবিয়া (রা:) রাজনৈতিকভাবে জিতে যান।"
আলী ও হাসান (রা:) -কে 'বৈধ খলিফা' এবং মুআবিয়াকে (রা:) 'অবৈধ খলিফা' হিশেবে আমি ভাবতে পারি না। দুটো কারণে আমি মুআবিয়াকে (রা:) 'অবৈধ খলিফা' বলতে পারিনা।
১. একজন সাহাবীর রাজনৈতিক ইজতিহাদকে 'ভুল' বলা এক জিনিস, 'অবৈধ' বলা আরেক জিনিস। 'অবৈধ' শব্দটি যে ওজন বহন করে, আমি একজন সাহাবীর ক্ষেত্রে সেটি ব্যবহার করতে আগ্রহী নই।
২. মুআবিয়াকে (রা:) 'অবৈধ' বলার অর্থ হলো ইসলামের খিলাফতের ইতিহাস ৪০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। অর্থাৎ, হাসান (রা:) -এর পদত্যাগের মাধ্যমে খিলাফতের বিলুপ্ত হয়েছে বলে ধরে নেয়া। এতে করে ইসলের ধ্রুপদী ১৪০০ বছরের খিলাফত ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়; যা ঐতিহাসিকভাবে ভুল। সর্বোচ্চ এতোটুকু বলা যায়, মুআবিয়ার (রা:) মাধ্যমে খলিফা নির্বাচনের এক নতুন ডাইমেনশন তৈরি হয়।
আলী-মুআবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) ইস্যুতে বৈধতার ফতোয়া আলীর (রা:) পক্ষে থাকলেও, সাহাবীদের বেশিরভাগের মতামত আলীর (রা:) পক্ষে থাকলেও রাজনৈতিক লড়াইয়ে জিতে যান মুআবিয়া। তাঁর এই জিতে যাওয়াকে 'অবৈধ বিজয়' না বলে 'রাজনৈতিক বিজয়' বলতে আমি আগ্রহী।
মুআবিয়া (রা:) -এর মাধ্যমে যে খিলাফতের ধারা শুরু হয়েছিলো, এই খিলাফতের নাম ছিলো 'উমাইয়া খিলাফত'৷ উমাইয়া খিলাফতের স্থায়িত্ব ছিলো ৮৯ বছর। এই খিলাফতের পতন হয় কিভাবে? রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে? উমাইয়াদেরকে গিয়ে কেউ বলে, "আপনারা এখন খিলাফতের যোগ্য না, আমাদের হাতে দিয়ে দিন" আর অমনি তারা দিয়ে খিলাফত দিয়েছিলো?
রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এতোটা সাদা-কালো না। ইতিহাসে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি একটি নীতিই ফলো করে- 'জোর যার, মুল্লুক তার'।
যে খিলাফত টানা ৮৯ বছর মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়, সেই খিলাফতের পতনের ঘটনা ছিলো লোমহর্ষক। নতুন খিলাফত- আব্বাসী খিলাফত।
খিলাফতের আসন 'দখল' নিয়ে উমাইয়া এবং আব্বাসীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দুই পক্ষই ছিলো মুসলিম (সেটা বলা বাহুল্য)। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি খিলাফতে অধিষ্ঠিত এবং খিলাফতের দাবিদার দুই পক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় 'যাব' নদীর তীরে।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট, আব্বাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে উমাইয়্যা খিলাফতের প্রথম মেয়াদের শেষ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদকে হত্যা করে আব্বাসীরা। আব্বাসীরা খুঁজে খুঁজে উমাইয়াদের হত্যা করতে থাকে। যেখানেই উমাইয়াদের পাচ্ছিলো, যারা ভবিষ্যতে হারানো খিলাফত দাবী করতে পারে, তাদেরকে হত্যা করা হয়। আব্বাসী নেতা আব্দুল্লাহ বিন আলী ৮০ জন উমাইয়াকে নিজ হাতে হত্যা করেন।
এই ছিলো ইসলামের ইতিহাসে নামকরা যে দুটো খিলাফত, সেই খিলাফতের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের ইতিহাস। খিলাফতের পালাবদল বা ক্ষমতার পালাবদল সাধারণত শান্তিপূর্ণভাবে হয় না, ফতোয়া (জায়েজ, না-জায়েজ) মেনে হয় না। নতুবা, আব্বাসীরা যেভাবে মানুষ মেরে খিলাফতের আসনে বসেছিলো, এরকম মানুষ মেরে ক্ষমতায় যাওয়া কি জায়েজ?
মনে করুন, আব্বাসীরা তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ফকীহ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরীকে (রাহিমাহুমুল্লাহ) গিয়ে যদি বলতেন, "আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। ক্ষমতায় যাবার জন্য আমরা ১০০০ জন মানুষকে হত্যা করতে চাই, খলিফাকে হত্যা করতে চাই। এটা কি আমাদের জন্য জায়েজ হবে?"
আপনার কি মনে হয়, এমন শর্তে ক্ষমতা দখলের প্রস্তাবকে ইমামগণ জায়েজ বলে ফতোয়া দিতেন? বর্তমান বিশ্বের এমন কোনো গণ্যমান্য আলেম এই ধরণের ক্ষমতা দখলকে অনুমোদন দিবেন বলে আপনার মনে হয়?
ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটি যদি ফতোয়ামুখী হতো, তাহলে মুআবিয়া (রা:) ফতোয়ার কাছে নতীস্বীকার করতেন, আব্বাসীরা উমাইয়াদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারতো না।
ক্ষমতা দখলের এমন ধারা আব্বাসী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরং ১৪০০ বছরের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখবেন, ক্ষমতার পালাবদল পেশীশক্তির মাধ্যমে হয়েছে। হোক সেটা খিলাফতের পালাবদল, হোক সেটা কোনো অঞ্চলের গভর্ণরের পালাবদল। যখনই বাহ্যিক কোনো শক্তি এসে খিলাফতের দাবী করেছে, তখন আপোষে বা জনগণের সম্মতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। মুসলিমে-মুসলিমে যুদ্ধ হয়েছে। যে বিজয়ী হয়েছে সে খিলাফত পেয়েছে, যে পরাজিত হয়েছে সে খিলাফত হারিয়েছে অথবা খিলাফতের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
আন্দালুস (স্পেন) ছিলো উমাইয়া নিয়ন্ত্রিত। আব্বাসীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছোট্ট শিশু আব্দুর রহমান আদ-দাখিল আব্দালুসে গিয়ে উমাইয়া খিলাফতের নতুন অধ্যায়ের পত্তন করেন। সেই আন্দালুস ছিলো ছোটো ছোটো নগর-রাষ্ট্রে বিভক্ত, যেগুলোকে বলা হতো 'তাইফা'।
এক তাইফার শাসকের সাথে আরেক তাইফার শাসকের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। দ্বন্দ্ব নিরসনে তারা এক ভয়ানক কাজ করতো। নিজের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান রাজার সাহায্য চাইতো। সেই খ্রিস্টান শাসক বাহিনী পাঠিয়ে এক তাইফা নেতার আহ্বানে আরেক তাইফা নেতার ঘাটিতে আক্রমণ চালাতো। মুসলিম-খ্রিস্টান বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে এক তাইফার পতন ঘটতো। তখন খ্রিস্টান শাসক তার আসল রূপ দেখাতো। সে সাহায্যকারীর বেশে এসেছিলো, সাহায্যও করেছিলো। কিন্তু যাবার আগে যার ডাকে এসেছিলো, তাকে হত্যা করে দুটো তাইফা দখল করে নিতো।
ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দুই মুসলিম শাসক কি জায়েজ, না-জায়েজের তোয়াক্কা করেছিলেন? একজন মুসলিম শাসককে দমিয়ে রাখতে খ্রিস্টান শাসকের সাহায্য প্রার্থনার বৈধতা কি কোনো মুসলিম স্কলার দিবেন?
অটোম্যান বা উসমানী খিলাফতে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটি ছিলো ভয়াবহ। যিনি খলিফা হতেন, তিনি তার ভাইদেরকে হত্যা করতেন৷ দ্বিতীয় বায়োজিদের সময় থেকে এই প্রথা শুরু হয়। তারা তাদের ভাইকে জীবিত রাখতেন না এই ভেবে, সে যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতা দাবি করে? ক্ষমতার প্রশ্নে আপন ভাই বা সৎ ভাইদেরকে হত্যা করতেন উসমানী খলিফারা।
সুলতান প্রথম আহমাদ (খিলাফতকাল: ১৬০৩-১৬১৭) খলিফা হবার পর এই আইনের পরিবর্তন আনেন। তখন থেকে খলিফা হবার পর আর ভাইদেরকে হত্যা করা হতো না, কিন্তু একটি হেরেমে বন্দী করে রাখা হতো। কোনো কারণে খলিফার মৃত্যু হলে হেরেমে বন্দী বয়স্ক ভাইকে খিলাফতের দায়িত্ব দেয়া হতো। কেউ কেউ খলিফা হবার পর দীর্ঘদিন পর বা জীবনে প্রথম আলোর মুখ দেখতেন।
ভাইকে মেরে খিলাফতের আসন পাকাপোক্ত করা, কিংবা ভাইকে বন্দী করে রেখে ক্ষমতাভোগ করার এই ধারা কি আমরা যে পার্ফেকশনিস্ট সেন্স থেকে জায়েজ, না-জায়েজ দেখি, সেই জায়গা থেকে কি দেখা যায়? এই ধরণের কাজের ধর্মীয় বৈধতা আছে?
আপনি পুরো ইসলামি ইতিহাসের রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনাগুলো যদি পড়েন, সেগুলোর বেশিরভাগের ধর্মীয় অনুমোদন বা বৈধতা খুঁজে পাবেন না। হোক সেটা বিদ্রোহী হওয়া, মানুষ মেরে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ভাইকে মেরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিশ্চিত করা। কুরআন-হাদীসের টেক্সট থেকে এই ধরণের কাজের অনুমোদন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, অসম্ভবও বটে।
ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি খিলাফত দেখেছে। খুলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসী খিলাফত, সেলজুক সালতানাত, মামলুক, আইয়ূবী, উসমানি খিলাফত। কেউ স্বতন্ত্রভাবে শাসন করেছেন, কেউ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (খিলাফত) দাবি করেছেন।
খুলাফায়ে রাশেদা পরবর্তী খিলাফতের ক্ষমতা দখলকে আপনি চাইলে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন। আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, "এই ধরণের ক্ষমতা দখল কি বৈধ?" কিন্তু, ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে বৈধতা-অবৈধতার মাপকাঠিতে মাপা হয়নি, মাপা যায় না। এভাবে মাপতে গেলে বৈধ খিলাফতের ইতিহাস আলী-হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) পর্যন্ত সমাপ্ত করতে হবে।
ইতিহাসে কোনো খিলাফতকে প্রশংসা করা হয়েছে, তাদের অবদানগুলো নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে। এটার মাপকাঠি ছিলো- তারা কিভাবে খিলাফত পরিচালনা করেছেন, তাদের খিলাফতে কুরআন-হাদীসের চর্চা, মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা, ইনসাফের চর্চা কতোটা হয়েছে সেটার আলোকে। খলিফা হবার পর যারা এগুলো ভালোভাবে করেছেন, তাদেরকে প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু, তারা কিভাবে খলিফা হয়েছেন কিংবা তাদের খিলাফত কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেটার মাপকাঠিতে তাদেরকে মাপা হয়নি।
যদি সাদা-কালো নীতিতে আব্বাসী খিলাফতকে মাপা হতো, তাহলে তাদের জ্ঞানের বিকাশের অবদান, সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে অবদান, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মাটিচাপা পড়ে যেতো তাদের ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে। তখন বলা হতো- 'যে খিলাফতের হাত উমাইয়াদের রক্তে রঞ্জিত, আরেক মুসলিম শাসককে যারা হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছে, তাদের কোনো অবদান গ্রহণযোগ্য নয়'।
এরকমটা কি বলা হয়? কেনো বলা হয় না? কারণ, রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়- ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, ক্ষমতা দখলের ইতিহাস নয়। যেভাবেই ক্ষমতা দখল করা হোক না কেনো, কালের পরিক্রমায় সেটার বৈধতার প্রশ্ন ঐভাবে উঠেনি। ক্ষমতা পাবার পর 'কী করেছে?' সেটাই হয়ে উঠেছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
দুই.
রাজনীতির আরেকটি বাস্তব উদাহরণে আসি। ১৯৩৫-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের মুসলিমদের মধ্যে দুই ধরণের বিভাজন দেখা যায়। একপক্ষ পাকিস্তান আন্দোলন তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে, আরেকপক্ষ ঐক্যবদ্ধ ভারতের তথা একজাতিতত্ত্বের পক্ষে।
আল্লামা ইকবাল দার্শনিক, রাজনৈতিক যুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলনের যথার্থতা তুলে ধরেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ.কে ফজলুল হক রাজনীতির ময়দানে সেটা প্রয়োগ করার দায়িত্ব নেন।
অন্যদিকে দারুল উলুম দেওবন্দের আলেমগণ এই প্রশ্নে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যান। এক পক্ষ পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে, আরেকপক্ষ ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে।
ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ)। পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহিমাহুল্লাহ)।
মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী মদীনা সনদের সাথে তুলনা করে ভারত ভাগের বিপক্ষে অবস্থান নেন। সভা-সমাবেশ করেন, একটি বইও লিখেন। একজাতীতত্ত্ব ভাষ্যকে রাজনীতির ময়দানে প্রয়োগ করেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। এই দলের একটি স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়- "হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই, মহাভারত এক চাই।"
মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহি:) এমন ঐক্যের আহ্ববান দেখে আল্লামা ইকবাল বেশ বিরক্ত হোন। ইকবাল তখন জীবন সায়াহ্নে। তিনি একটি কবিতায় মাওলানার বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন- 'আজম জানে না আজও ধর্মের রহস্য বিবরণ/নইলে দেওবন্দ হুসেন আহমেদ এই আজব কথাটি...'
অন্যদিকে মাওলানা মওদূদী (রাহিমাহুল্লাহ) মাওলানা হুসাইম আহমদ মাদানীর (রাহি:) একজাতিতত্ত্বকে কুরআন-হাদীসের আলোকে রিফিউট করে লিখেন (যা অনূদিত) 'ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ'। তিনি এই বইয়ে দেখান, ভ্রাতৃত্ব হবে মুসলিমে-মুসলিমে, বিশ্বাসী-বিশ্বাসীর মধ্যে; কুরআন-হাদীস এটাই বলে। এই বইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলন ধর্মীয় স্বীকৃতিলাভের যুক্তি-প্রমাণ পায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মুসলিমদের মধ্যে দুটো গ্রুপ। এখন আপনি কোন পক্ষে? আপনি হিন্দুদের সাথে সহাবস্থান করে সংখ্যালঘু হয়ে ভারতে থাকতে চান? নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে মুসলিম ভূখণ্ড পাকিস্তানে থাকতে চান?
এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। এটা হক্ব বনাম বাতিল, জায়েজ বনাম না-জায়েজের প্রশ্ন না।
পুরো বিষয়টিকে যদি আপনি ধর্মীয় টেক্সটের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তাহলে একজাতিতত্ত্ব তথা মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহি:) পক্ষে অবস্থান করার যুক্তি বেশ দূর্বল মনে হবে। পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই তো এই জায়গায় রাজনৈতিক আক্রোশ থেকে মাওলানাকে 'কংগ্রেসের দালাল' পর্যন্ত বলেন!
ইসলামি টেক্সট, ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা, মুসলিমদের স্বকীয়তার প্রশ্নে আমি পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে। কিন্তু, মাওলানা মাদানীর (রাহি:) তত্ত্বটি রাজনৈতিক প্রশ্নে উত্তীর্ণ। তাঁর অবস্থানকে আমি দেখি ভারতের হারানো মুসলিম সভ্যতার শিকড়ের টান থেকে। যে ভারত দীর্ঘদিন মুসলিমরা শাসন করেছে, যে ভারতে ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান আছে, সেই ভারত ছেড়ে এমনি-এমনি চলে যাবো? ভারতের কয়েক কোটি মুসলিম নতুন করে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে? কোটি কোটি পুনর্বাসন এতোই সহজ?
নিকট অতীতে পাকিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের আলেম-উলামাদের মধ্যে যে পরিমাণ ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো, সেটার প্রভাব দুই রাষ্ট্রকে ভাগ করার সময় কতোটুকু ছিলো? আরো সংক্ষেপে বললে, যারা ভারত ভাগ করেন, সেই মাউন্ট ব্যাটেন, র্যাডক্লিফ, নেহেরু, মাউন্ট ব্যাটেনের সুন্দরী স্ত্রী এডউইনা, জিন্নাহর কাছে জায়েজ, না-জায়েজ ফতোয়াগুলো কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো?
তিন.
রাজনীতিতে ক্ষমতা দখল হয় বাহুবলে, কখনো বা সুকৌশলে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে (যেমনটা পলাশীর যুদ্ধে দেখতে পাই)। কিন্তু, ক্ষমতা দখলের বেলায় ফতোয়া তেমন একটা প্রভাব রাখে না। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রের সাথে, খিলাফতের স্বার্থে মুফতি/মাওলানার প্রয়োজন পড়ে। রাষ্ট্র কিভাবে চলবে, তারা পরামর্শ দেন।
'ক্ষমতা কিভাবে অর্জন করা যাবে কিংবা দখল করা যাবে' এই সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে ডিল করা অরাজনৈতিক মুফতি-মাওলানাদের কাজ না। ঐতিহাসিকভাবে এই বিষয়টি প্রমাণিত।
অন্যদিকে যেসব আলেম রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন, তারা শুধুমাত্র ফতোয়া দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। নিজেরা সেটা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় তাতারীদের বিরুদ্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ), ইংরেজদের বিরুদ্ধে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)। তারা রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা শুধু ফতোয়া-কেন্দ্রীক ছিলো না, সেটা বাস্তবায়নের জন্য নিজেরা মাঠে নেমেছেন, নতুবা উত্তরসূরী গড়ে তুলেছিলেন।
তাই বলে কি অরাজনৈতিক আলেম রাজনীতির ক্ষমতা দখল নিয়ে কথা বলবেন না? ফতোয়া দিবেন না? হ্যাঁ, দিবেন। এটা তাদের দায়িত্ব।
অন্যদিকে, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো ক্ষমতা অর্জন বা দখল সংক্রান্ত বিষয়াদীতে অরাজনৈতিক মুফতি সাহেবদের কথায় কান না দেয়া। অতীতের কোনো সফল বিজেতা যদি এই কাজটি করতেন, তাহলে তাদের আর ক্ষমতা অর্জন/দখল করা হতো না।
বিজেতারা পথের অনুসরণ করে না, পথের সূচনা করে। তাদের দেখানো পথে জাতি হাঁটে।
---
|| ইতিহাসের আলোকে ক্ষমতা তত্ত্ব ||
- আরিফুল ইসলাম
Tags:
ধর্ম চিন্তা