হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একজন সাহাবা ও সেবক। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুর-রহমান ইবনে সা’খর অথবা উমায়র ইবনে আমির। তিনি তিন বছর নবী মুহাম্মদ(সা:) এর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বহুসংখ্যক হাদীস আত্মস্থ করেন এবং বর্ননা করেন| হিসাব অনুযায়ী, ৫,৩৭৫ টি হাদীস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। বলা হত যে, উর্বর মস্তিষ্ক ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি| তাঁর কাছ থেকে আটশত তাবেঈ হাদীস শিক্ষা লাভ করেছিলেন|
সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষের আলোকে:
“তিনি দক্ষিণ আরবের আজদ্ গোত্রের সুলায়ম ইবনে ফাহম্ বংশোদ্ভূত। ‘আবু হুরায়রা’ উপনামে তিনি সমাধিক পরিচিত। তাঁর প্রকৃত নাম সম্বন্ধে পরস্পরবিরোধী বর্ণনা দৃষ্ট হয়। অধিকতর বিশ্বস্ত বিবরণ মতে তাঁর নাম আব্দুর-রহমান ইব্ন সা’খর অথবা উমায়র ইব্নে আমির। বিড়ালের প্রতি স্নেহাধিক্যের জন্য তিনি আবু হুরায়রা (অর্থাৎ ছোট বিড়ালের পিতা) নামে অভিহিত হন। এই উপনামের জনপ্রিয়তা তাঁর আসল নামটিকে আড়াল করে দাঁড়ায়।
আবু হুরায়রা (রা) হুদায়বিয়ার সন্ধি এবং খায়বর [৭/৬২৯] যুদ্ধের অন্তর্র্বতী সময়ে মদিনায় আগমন করে ইছলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছরের মতো। তখন থেকে তিনি রাসূলের (সা) পবিত্র সাহচর্য অবলম্বন করেন। এবং ‘আসহাবুস্ সুফফার’ অন্তর্ভুক্ত হন। প্রথম দিকে তিনি ক্ষুণিœবৃত্তির জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকু পরিমাণ মজুরের কাজ করতেন। যথা: জঙ্গল হতে জ্বালানি সংগ্রহ, মনিবের উটের রশি টেনে চলা ইত্যাদি...।
রাছুল যে খাদ্য হাদিয়া পেতেন, প্রায় সময়ই তা আসহাবুস্ সুফফার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আবু হুরায়রার ভাগে যতটুকু পড়তো, অত্যন্ত অপর্যাপ্ত হলেও তা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। ছাহাবীগণ তাঁকে কখনও ক্ষুধায় কাতর দেখলে নিজের গৃহে ডেকে এনে আহার করাতেন। একদা জাফর ইবনে আবু তালিব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যান; কিন্তু ঘরে কিছু না থাকায় ঘি’এর শূন্য পাত্রটি হাজির করলেন। আবু হোরায়রা তা-ই চেটে ক্ষুণিœবৃত্তির প্রয়াস পেলেন। অনেক সময় খেজুর আর পানি খেয়েই তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। কখনও কখনও পেটে পাথর বেঁধে শুয়ে থাকতেন; কিন্তু কোনো দিন কারো নিকট কিছু চাইতেন না। ছাহাবীদের যুগেই আবু হোরায়রা কর্তৃক অপর সকলের অপেক্ষা অধিকতর হাদিছ বর্ণনা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। উত্তরে আবু হোরায়রা স্বয়ং বলেন, “আমার সম্বন্ধে অভিযোগ, আমি কেমন করে এত অধিক সংখ্যক হাদিছ বর্ণনা করি। এর কারণ...।”
রাছুলের সময় আবু হোরায়রা (রা) সংসারবিরাগী চরম দারিদ্র্যে দিন কাটালেও পরবর্তী জীবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন। সন্তান-সন্ততির পিতা হন এবং ধনসম্পদের অধিকারী হন। ইছলামী শরিয়তে তার ব্যুৎপত্তি, বিদ্যা-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় ওমরের (রা) গভীর আস্থা ছিল। তিনি তাঁকে বাহরায়ন প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু অর্থ সঞ্চয়ের অপবাদে তাকে বরখাস্ত করেন। যথাবিহিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সন্দেহ দূর হলে পরে তাকে পুনরায় উক্ত পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু আবু হুরায়রা (রা)-এর আহত আত্ম সম্ভ্রমবোধ উক্ত পদ পুনঃ গ্রহণে তাঁকে নিরুৎসাহ করে তোলে। আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত হাদিছের সংখ্যাধিক্যের জন্য তার হাদিছ সাধারণত অগ্রাহ্য মনে করেন। কিন্তু এর পশ্চাতে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই।” [দ্র: সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষ; ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ, আবু হোরায়রা অধ্যায়; পৃ: ৫৭; ই. ফা.]
রাসূলের শেষ জীবনে অর্থাৎ ৬০ বছর বয়সের সময় ৩০ বছরের আবু হোরায়রা মুসলিম হন। অর্থাৎ মাত্র ৩ বছর রাসূলের সাহচর্যে ছিলেন। মুছলিম হওয়ার পরেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেকার, কর্ম বিমুখ, অলস ও ভবঘুরে। আর এমন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন যে তাঁর সঠিক নামটি পর্যন্ত কেউ জানতেন না। আজও কেউ সঠিক করে তাঁর নাম বলতে পারেন না।
কথিত হয় রাসূলের সময় তিনি বায়তুল মালের পাহারাদার ছিলেন; রাসূলের বার বার সতর্ক করার পরেও দায়িত্বের বরখেলাপ, ঘুষ বা যে কোনো ব্যক্তিগত লোভেই হোক মাল পাচারের সহযোগিতায় পর পর তিন বার রাছুল কর্তৃক অভিযুক্ত হন। ঘটনাটি আলেম মোহাদ্দেছগণ ঠোঁট বাঁকা করে অর্থাৎ কূট-কৌশলে বর্ণনা করেন বলেই সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না। দেখুন:
শয়তানের নামে হাদিছটি রচনা করার উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্ট নয়। স্বয়ং রাছুলের সাহচর্যে থেকে অন্যের পরামর্শ নেয়া ধৃষ্ঠতা ছাড়া আর কি!
২. প্রথম খলিফা আবু বকরের সময় আবু হোরায়রার কোনো খোঁজ খবরই ছিল না কিন্তু ওমরের সময় তিনি বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এখানেও তিনি অর্থ আত্মস্বাদের দায়ে ওমর কর্তৃক অভিযুক্ত হয়ে পদ থেকে বহিষ্কৃত হন।
ঘটনা তদন্তের পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ওমর তাকে পুনরায় ঐ পদে বহাল রাখার অনুরোধ করেন বলে মুহাদ্দেসগণ ইতিহাস রচনা করেছেন বটে; কিন্তু যে ওমর আপন সন্তানকে অভিযুক্ত প্রমাণে মৃত্যুদণ্ড দেন; সেই ওমর অভিযোগের তদন্ত না করেই তাঁকে পদচ্যুত করেন; অতঃপর তদন্ত করেন। অতঃপর মিথ্যা অভিযোগের ফলে কোনো ছাহাবাকে দণ্ডিত করেছেন এমন কোনো হাদিছ-ইতিহাস রচিত হয়নি; অতএব মোহাদ্দেছদের মন্তব্য বিশ্বাস করার অর্থ ওমরকে খলিফা হিসেবে অযোগ্য ও হেয় প্রতিপন্ন করা। সম্ভবত ওমরের ওপর পূর্ব থেকেই ইমামগণ নাখোস ছিলেন কারণ হয়ত ওমর জনসাধারণের কাছে হাদিছ লেখার কথা দিয়েও তা পূরণ করেননি, বরং প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
৩. কথিত হয় তিনি দুর্দান্ত কপর্দকহীন চূড়ান্ত অলস ভিখারী ছিলেন; কিন্তু ওমরের আমলে শাসনকর্তা হওয়ার পরেই হঠাৎ করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হন, বিয়ে-সাদি করেন এবং সন্তানাদির বাপও হন। অতএব প্রশ্ন জাগে যে, কপর্দকহীন, ভবঘুরে, অন্যের ঘরের ঘি’এর শূন্য পাত্র চেটে খাওয়া আবু হোরায়রা এত ধনসম্পত্তি কিভাবে, কোথা থেকে পেলেন! তার কোনো ইতিহাস রচিত হয়নি।
৪. তিনি মহানবী সম্বন্ধে অতিরিক্ত কথা বলতেন, বাংলায় যাকে ‘বাচাল’ বলে; সে কারণে ছাহাবাগণই প্রতিবাদ করতেন। মোহাদ্দেছগণ লিখেছেন, ‘বেশি হাদিছ বলতেন বলেই অন্য ছাহাবাগণ প্রতিবাদ করতেন।’ মূলত এ যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই; কারণ বেশি বেশি হোক বা কমই হোক সত্য [?] কথা [হাদিস] বলতেন, অথচ ছাহাবাগণ প্রতিবাদ করতেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন! এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
৫. মাত্র তিন বছরে মহানবীর (সা.) সাহচার্যে থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হাদিছ বয়ান করেছেন! পক্ষান্তরে, খোলাফায়ে রাশেদ্বীনগণ সারাজীবন রাছুলের সাহচর্যে থেকে মাত্র পাঁচ শত হাদিছ রচনা করতেও সাহসী হননি!
৬. মহানবীর (সা.) ‘খেতাব’ প্রদানের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আল্লামাদের উক্তি বড়ই হতাশাজনক। যেমন: মহানবী আলীকে ‘তোরাব’ খেতাবে ভূষিত করেন। এর ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আল্লামাগণ বলেন, “একদা আলী বিবি ফাতেমার সঙ্গে ঝগড়া করে রাগে ঘর ছেড়ে মসজিদে গিয়ে শুয়ে থাকেন; মহানবী তাকে খুঁজতে খুঁজতে ঐ মসজিদে গিয়ে দেখেন যে, আলী মাটিতে ধুলা বালুর মধ্যে শুয়ে আছেন, গায়ে ধুলা বালু। তাই দেখে মহানবী তাকে ‘তোরাব’ খেতাবে ভূষিত করেন।
ব্যাখ্যাটি যে নিতান্ত শিশুসুলভ তা সকলেই স্বীকার করবেন। মহানবী সাধারণের মতো এত হালকা জ্ঞান ধারণ করতেন না। আর আজকের রাজনীতিকদের মতো কোনো ইস্যু নিয়ে হইহল্লা করে ব্যক্তি ও দলের সমর্থন আদায়ের জন্য খেতাব বিলি করতেন না। মূলত আলী ছিলেন সমস্ত মুছলিম জাহানের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, উদার, শান্ত, ধীর, স্থীর ও অটল। যার তুলনা একমাত্র মাটির সঙ্গেই করা সম্ভব; আর তাই তিনি তাকে ‘তোরাব আলী’ খেতাবে ভূষিত করেন। আবু হোরায়রা প্রকৃতপক্ষে বিড়াল স্বভাবের ছিলেন বলেই তাকে উক্ত খেতাব দিয়েছিলেন। এটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ও প্রমাণিত।
৭. কোরানে উল্লেখ আছে যে, অ লা তুতিউ ক্বুল্লা হাল্লাফিম্মাহিনিন [৬৮: কালাম-১০] অর্থ: যারা কথায় কথায় কসম কাটে তাদেরকে বিশ্বাস করো না। বা অনুসরণ করো না পরমলাঞ্ছিত অধিক কসমকারীর। পক্ষান্তরে আবু হোরায়রার বর্ণিত হাদিছে অসংখ্য ‘কসমের’ সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
৮. মহানবী স্বয়ং উপস্থিত তদুপরি তাঁরই অধীনে কর্মচারী হয়েও অপরিচিত লোকের [মানুষরূপী শয়তানের!] প্ররোচনায় আদিষ্ট আবু হোরায়রার জন্য মুছলিম বিশ্বের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া আর কী বা করার আছে!
৯. হাদিছে প্রকাশ: মৃত্যুর আগে মাত্র একবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যটি আবৃত্তি করতে পারলে তার জন্য দোযখ হারাম হয়! রাছুলের নামে এমন ফতোয়া প্রচার করায় দ্বিতীয় খলিফা ওমর আবু হোরায়রাকে বেদম প্রহার করেন-! [দ্র: মিশকাতুল মাসাবীহ ১ম খ. ১ম প্রকাশ, হা. নং-৩৫, পৃ: ৬৭ (মুছলিম)]
১০. তাঁর চরিত্রের চূড়ান্ত সাক্ষী দিয়েছেন আবু হোরায়রা ভক্ত স্বয়ং জনাব আজিজুল হক; তার বর্ণিত ৫,৩৭৫টি হাদিছের মধ্যে একটি মাত্র হাদিছও কোরান সম্মত যে নয় তা স্বঘোষিত শায়খ সাহেব নিজেই স্বীকার করেন; কোরান নিয়ে কেউ (মরহুম আকরাম খাঁ) কখনও হাদিছ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে আবু হোরায়রার একটি হাদিছও রক্ষা পাবে না! এই ভয়ে তিনি হতাশ জীবন যাপন করছেন! [দ্র: বোখারী, ৫ম খ. ৫ম সংস্করণ, উপক্রমিকার সমালোচনা; পৃ: ২১; আ. হক]