মুনাফিক (আরবিতে: منافق, বহুবচন মুনাফিকুন) একটি ইসলামি পরিভাষা যার অর্থ একজন প্রতারক বা "ভন্ড ধার্মিক" ব্যক্তি। যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে; কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আর এ ধরনের প্রতারণাকে বলা হয় নিফাক (আরবি: نفاق)।
নিফাক বা মোনাফেকী দু প্রকার
১ বিশ্বাসগত নিফাক : এটি বড় কুফর যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। তা ছয় প্রকার : রাসূলকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা, অথবা রাসূল যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার কোনো কিছুকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা, কিংবা রাসূলকে ঘৃণা করা, অথবা রাসূল যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তাকে ঘৃণা করা, রাসূলের দ্বীনের ক্ষতিতে খুশি হওয়া অথবা রাসূলের দ্বীনের বিজয় অপছন্দ করা।
২ কর্মগত নিফাক : তা হল ছোট কুফর যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে না। তবে তা বড় ধরনের অপরাধ ও মহাপাপ। তন্মধ্যে রয়েছে সে আমল যা নবী (সা.) হাদীসে উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন :
"চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হবে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। সেগুলো হল : ১. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে; ২. কথা বললে মিথ্যা বলে; ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে; এবং ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল গালি দেয়।"[২]
কুরআনের শতাধিক আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে[১] এবং মুসলমানদের জন্য তাদের অমুসলিম শত্রুদের তুলনায় মুনাফিকদেরকে অধিক বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআনের আলোকে মুনাফিকের চরিত্র
মুনাফিকের চরিত্র : আল্লাহ সুরা বাকারার ৮ থেকে ২০ পর্যন্ত মোট ১৩টি আয়াত মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সুরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো—
দুমুখো স্বভাবের
‘আর মানুষের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি, অথচ তারা মুমিন নয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮)
প্রতারক ও ধোঁকাবাজ
‘আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না, বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে, অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৯)
তাদের অন্তর অসুস্থ
‘তাদের হৃদয়ে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ সে ব্যাধিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের মিথ্যাচারের দরুন তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা : আল বাকারা, আয়াত : ১০)
নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী মনে করে
‘আর যখনই তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি কোরো না, তারা উত্তরে বলে—আমরাই তো সংশোধনকারী ও শান্তিকামী।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১)
ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী
‘সাবধান! এরাই ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী, কিন্তু তাদের সে অনুভূতি নেই।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২)
মুমিনদের নির্বোধ মনে করে
‘যখন তাদের বলা হয়, অন্য লোকদের ন্যায় তোমরাও ঈমান আনো, তখন তারা বলে, আমরা কি সেই নির্বোধ লোকদের মতো ঈমান আনব? আসলে তারাই তো নির্বোধ, কিন্তু তাদের সে জ্ঞান নেই।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩)
উপহাসকারী
‘যখন তারা মুমিনদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আবার যখন নিরিবিলি তাদের শয়তানদের মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই আছি। আমরা তাদের সঙ্গে শুধু ঠাট্টা-তামাশা করছি মাত্র।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪)
অবাধ্যতার বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ায়
‘বস্তুত আল্লাহই তাদের সঙ্গে তামাশা করছেন এবং তাদের তাদের অবাধ্যতার বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দিচ্ছেন।’ (সুরা বাকারা-১৬)
‘আমি শাস্তি না দিয়ে সুযোগ দিই পাপ বৃদ্ধির জন্য।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৭৮)
ভ্রষ্টতা ক্রয় করে
‘তারা এমন লোক, যারা হেদায়েতের পরিবর্তে ভ্রষ্টতাকে ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি; আর তারা হেদায়েতও পায়নি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬)
‘তাদের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালিয়েছে; কিন্তু যখন তা তার চারপাশ আলোকিত করল, তখন আল্লাহ তাদের আলো অপসারিত করে তাদের ঘোর অন্ধকারে ফেলে দিয়েছেন, যাতে তারা কিছুই দেখতে পায় না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭)
তারা বধির, মূক ও অন্ধ
‘তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। তারা আদৌ ফিরে আসবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮)
তারা সন্দেহপ্রবণ, দ্বিধাগ্রস্ত ও সুবিধাবাদী
বর্ষণমুখর ঘন মেঘের মতো, যাতে রয়েছে ঘোর অন্ধকার, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুতের চমক; বজ্রধ্বনিতে মৃত্যুভয়ে তারা তাদের কানে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়; আল্লাহ এসব সত্য প্রত্যাখ্যানকারী লোকদের সর্বদিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। অর্থাৎ তারা আল্লাহর আয়ত্তের ভেতরে আছে, তিনি তাদের সম্পর্কে জানেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯)
মিথ্যাবাদী
‘মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ১)
আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টিকারী
‘তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ২)
অহংকারী
‘আপনি তাদের দেখবেন যে তারা অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ৬)
প্রতারক
‘অবশ্যই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করছে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোকদেখানোর জন্য দাঁড়ায়। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৩-১৪৪)
মুনাফিকদের আরো অনেক বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি কুরআনে বর্ণিত আছে। আল্লাহ আমাদের এসব থেকে হেফাজত করুন।
'রাব্বানা ও তাকাব্বাল দু'আয়ি (১৪:৪০); অর্থ- (আমাদের রব! আমার দূ'আ কবূল করুন)